চাঁদপুরে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ওয়াশব্লক না থাকায় চরম দুর্ভোগ

সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বহীনতায় বাড়ছে শিক্ষাভীতি

ইলশেপাড় রিপোর্ট
চাঁদপুর জেলার প্রায় এক-চতুর্থাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নেই ওয়াশব্লক (টয়লেট)। এতে করে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগের সীমা নেই। এমন পরিস্থিতিতে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে শিক্ষার্থীদের মাঝে স্কুলভীতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
জানা গেছে, যেসব বিদ্যালয়ে ওয়াশব্লক নেই তার অধিকাংশই একসময়ের বেসরকারি রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় তথা জাতীয়করণকৃত বিদ্যালয়। এসব বিদ্যালয়গুলো স্থাপনকালে প্রতিষ্ঠাতারা স্বল্প জায়গায় কোনমতে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে যাওয়ায় এমন দুর্ভোগের সৃষ্টি হয়। পরে জাতীয়করণ করা হলেও নতুন ভবন তৈরির পর নির্দিষ্ট পরিমাণ ভূমি না থাকায় জনস্বাস্থ্য বিভাগ সেখানে ওয়াশব্লক করতে পারছেন না। এছাড়া রয়েছে শিক্ষা কর্মকর্তাদের গোয়ার্তুমি। তারা যখন যা ভাবেন তাই করতে পছন্দ করেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। এ দুর্ভোগ রোধে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা অফিসগুলোরও নেই তেমন চিন্তা-ভাবনা। যার কারণে প্রতিনিয়তই শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগের পরিমাণ বেড়েই চলছে।
এ বিষয়ে চাঁদপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরে জেলার দুইশ’ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ওয়াশব্লক নির্মাণের জন্য অধিদপ্তরে জানানো হয়েছে। এতে করে প্রত্যেক উপজেলায় ২৫টি করে বিদ্যালয় অগ্রাধিকার পাবে। বর্তমানে এ জেলার ৮টি উপজেলায় মোট প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ১ হাজার ১শ’ ৫৬টি।
জানা গেছে, শিক্ষা অফিসগুলো প্রতি বছর বিদ্যালয়গুলোর কাছ থেকে তাদের একাডেমিক ভবনের পরিসংখ্যান ও অবস্থা জানতে চান। তারপর জরাজীর্ণ কিংবা পরিত্যক্ত ভবনগুলেকে নতুন ভবন করার জন্য সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরে চাহিদাপত্র প্রেরণ করেন। তার আলোকেই প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন একাডেমিক ভবন পেয়ে থাকে।
তবে নতুন একাডেমিক ভবন নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অভিযোগের শেষ নেই। তারা দাবি করছেন, যে প্রতিষ্ঠাগুলোতেই নতুন বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয় না কেন, এসব ভবনে থাকে না কোন ওয়াশবল্কের ব্যবস্থা। দেখা যায়, একাডেমিক ভবন হচ্ছে চার তলা। কিন্তু টয়লেটের ব্যবস্থা না থাকায় কোমলমতি শিক্ষার্থীরা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে পড়তে হয় বিড়ম্বনায়। কোন শিক্ষক বা শিক্ষার্থীর প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গেলে ছুটতে হয় পার্শ্ববর্তী কোন বাড়িতে।
এতে করে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ভীতি ও ঝরে পরার মতো ঘটনা ঘটছে হরহামেশাই। এমন পরিস্থিতিরোধে সংশ্লিষ্টদের কোন প্রতিকারের উদ্যোগও নেই। আর এ কারণে শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে।
চাঁদপুর সদর উপজেলার বেশ কয়েকজন প্রধান শিক্ষক অনেকটাই আক্ষেপ করে জানান, সংশ্লিষ্টরা এমন দুর্ভোগের বিষয়টি যেনেও সময়োপযুগী কোন ব্যবস্থা নেন না। এতে করে কেবল কোমলমতি শিক্ষার্থীরাই যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা নয়, কর্মরত সব নারী শিক্ষকদেরও কর্মস্থলে বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। শিক্ষকরা নিজদের প্রয়োজনে ব্যক্তিগত টাকা দিয়ে রিং স্লাব বসিয়ে টয়লেট নির্মাণ করে নিজেদের রক্ষা করতে হচ্ছে।
শিক্ষকদের এমন দাবির বিষয়টি সম্পর্কে সদর উপজেলা শিক্ষা অফিসার নাজমা বেগম সত্যতা স্বীকার করেছেন। তিনি ইতোমধ্যে উপজেলা সমন্বয় সভায় প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর এমন সমস্যার সমাধানের জন্য ঘোষণা দিয়েছেন- যদি বর্তমানে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বহুতল ভবন নির্মাণ হয় এবং ঐসব ভবনে ওয়াশব্লক বরাদ্দ না থাকে তাহলে ভবনের অনুমতি দিবেন না তিনি।
এ বিষয়ে শিক্ষা অফিসার নাজমা বেগম জানান, অধিদপ্তর থেকে যেভাবে ভবনের নকশা বা প্ল্যান পাস করা হয় সেভাবেই সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার ভবন নির্মাণ করে থাকেন। আর এ কারণে আমরা কিংবা সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়গুলো ওয়াশব্লক সম্পর্কে কিছুই করার থাকে না। আর এ কারণেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আগামিতে যখন কোন নতুন ভবনের আদেশ হবে তখন ওয়াশব্লক না থাকলে ঐ ভবনের অনুমতি শিক্ষা অফিস দিবে না।
প্রাথমিকে কর্মরত সাধারণ শিক্ষকরা জানান, দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিষ্ঠানগুলোতে বহুতল ভবন নির্মাণ হয়ে আসছে। কিন্তু ভবনের প্ল্যান পরিকল্পনা উপজেলা শিক্ষা অফিস দিয়ে থাকলেও তারা ভবনগুলো তো কোন ওয়াশব্লকের পরিকল্পনা অধিদপ্তরকে দেন না। তারা ঠিকাদারি কিংবা কোন ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের মতামতেই চাহিদাপত্র অধিদপ্তরে প্রেরণ করেন। যার কারণে এমন দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়ে আসছে।
এজন্য শিক্ষকরা দাবি করছেন, কর্মরত উপজেলা শিক্ষা অফিসার কিংবা সহকারী শিক্ষা অফিসাররা যদি দায়িত্ববান কিংবা নিজ মেধামননে কর্মক্ষম হন তাহলে কেবল দুর্ভোগ লাঘবই হবে না, শিক্ষার্থীদের স্কুলভীতি ও ঝরে পরার মতো ঘটনারোধ করা সম্ভব।

চাঁদপুরে শিক্ষা অফিসার নতুন ভবনের অনুমতি দিবেন না!

চাঁদপুর সদর উপজেলা শিক্ষা অফিসার (ইউইও) নাজমা বেগম তার এ উপজেলায় আর কোন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নতুন একাডেমিক ভবনের অনুমতি দিবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি সম্প্রতি উপজেলা পরিষদের মাসিক সমন্বয় সভায় প্রকাশ্য এমন হুংকার দেন।
তিনি বলেন, ওয়াশব্লকের জায়গা না রেখে বিভিন্ন স্থানে নতুন ভবন তৈরি করায় নানা সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। তাই আর নতুন ভবনের অনুমতি তিনি দেবেন না। কিন্তু ওয়াশব্লক ছাড়া নতুন ভবনগুলোর শিক্ষক-শিক্ষার্থীর জন্য কোন ব্যবস্থা তিনি করে দিচ্ছেন না। ফলে নতুন ভবন হলেও ওয়াশবল্ক, অর্থাৎ টয়লেট ছাড়াই শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের স্কুল করতে হচ্ছে।
প্রায় ৮ বছর একই কর্মস্থলে থাকায় এখন তিনি নিজেকে ব্যাপক ক্ষমতাধর মনে করে আসছেন বলে তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠছে। খোদ শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির নির্বাচনী এলাকার একজন শিক্ষা কর্মকর্তা এভাবে সরকারের উন্নয়নের অংশ বন্ধ করে দিতে পারেন না বলে অভিজ্ঞজন জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে কোন কথা বললে শিক্ষা কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের অহেতুক হয়রানী করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, যেসব প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক ভবন নেই কিংবা আগের ভবনগুলো জরাঝীর্ণ সেসব বিদ্যালয়গুলোতে নতুন ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হয়। তবে যে প্রতিষ্ঠানেই নতুন বহুতল ভবন নির্মাণ করা হোক না কেন কোন ভবনেই থাকছে না ওয়াশবল্ক (টয়লেট)। এতে করে প্রাথমিকের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে পড়তে হয় বিড়ম্বনায়।
এ জেলার সংশ্লিষ্ট শিক্ষা অফিসাররা দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যালয়গুলোর এমন চিত্র দেখার পরও অজ্ঞাত কারণে প্রতিকারের উদ্যোগ নিচ্ছেন না বলে অভিযোগ উঠছে। এমনকি কোন প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক কিংবা সহকারী শিক্ষক এসব বিষয় নিয়ে সংশ্লিষ্টদের জানালে উল্টো বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষকরা বলছেন, সরকার ইতোমধ্যে প্রাক-প্রাথমিককে দুই বছর করার ঘোষণা দিয়েছে। ইতোপূর্বে যেখানে ৫ বছরের শিশুরা প্রাক-প্রাথমিকে ভর্তি হতো, এখন ৪ বছরের শিশুরা বিদ্যালয়ে আসবে। এসব কোমলমতি শিক্ষার্থীরা যেখানে নিজে-নিজে ওয়াশরুম ব্যবহারের সক্ষমতা অর্জন করেনি, সেখানে বিদ্যালয়গুলোতে এক স্থানে ক্লাশের ভবন আরেক স্থানে ওয়াশব্লক হয় তখন কেমন বিড়ম্বনার শিকার হতে হয় শিক্ষকসহ শিক্ষার্থীদের- তা কেবল ভুক্তভোগীরাই জানেন।
প্রাথমিকের নতুন ভবনগুলোতে কেন ওয়াশব্লক থাকে না তা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের তেমন কোন মাথা ব্যথা নেই। অথচ মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক কিংবা মাদ্রাসাগুলোর যে কোন নতুন ভবন নির্মাণ হলেই প্রতিটি ফ্লোরেই থাকছে ওয়াশব্লক। এমনকি এসব ওয়াসব্লকগুলোতে থাকে একাধিক ফ্লাশ সিস্টেম কমোড ও বেসিন। এতে করে শিক্ষার্থীদের এক ফ্লোর থেকে অপর ফ্লোরে প্রকৃতির ডাকে দৌঁড়াদৌড়ি করতে হয় না। তাহলে প্রাথমিকে কেন এমন অবস্থা।
এ বিষয়ে চাঁদপুরে কর্মরত শিক্ষা অফিসাররা বলছেন, সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর যেভাবে ভবনের নকশা দেয় তার বাইরে আমাদের কিছু করার নেই। আর ওয়াশব্লক নির্মাণের দায়িত্ব স্ব-স্ব উপজেলা স্বাস্থ্য প্রকৌশলের। এমন অজুহাত দিয়েই নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে চান শিক্ষা অফিসগুলো।
অপরদিকে চাঁদপুরে কর্মরত শিক্ষকরা বলছেন, অধিদপ্তরের অজুহাত দিয়ে মূলত শিক্ষা অফিস তাদের ব্যর্থতা ঢাকতে চায়। শিক্ষার মান উন্নোয়নে যখন যেমন সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার তা যদি অধিদপ্তরকে বুঝানো যায় তাহলেই সেভাবেই ভবন করা যায়। মূলত শিক্ষা অফিসগুলো এ ব্যাপারে থাকে উদাসীন।
এদিকে চাঁদপুর সদর উপজেলার শিক্ষা অফিসার নাজমা বেগমের দিন-দিন দায়িত্বজ্ঞানহীন কর্মকাণ্ডে শিক্ষকরা অসহায় হয়ে উঠছেন। তিনি এখানকার শিক্ষার মানোন্নয়নে তেমন কোন ভূমিকা না রাখলেও শিক্ষকদের হয়রানি অব্যাহত রাখছেন নিয়মিতই। কর্মরত শিক্ষকরা দাবি করছেন, দীর্ঘদিন তিনি একই কর্মস্থলে বহাল থাকায় এখন তিনি কোন কিছুকেই তোয়াক্কা করছেন না।
শিক্ষকরা অভিযোগ করছেন, বিশেষ করে ২০১৩ সালে জাতীয়করণকৃত রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো ব্যাপক সমস্যা রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানগুলোতে নেই পর্যাপ্ত অবকাঠামোগত সুবিধা, ওয়াশব্লক, ক্লাশ রুমে বেঞ্চসহ অন্যান্য সুবিধাগুলো। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানগুলোকে আধুনিকায়নে সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতায় ব্যাপকভাবে অসহায় হয়ে পরছেন ঐসব প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরত শিক্ষকরা।
বর্তমান এমন পরিস্থিতি উন্নয়নে চাঁদপুরে এমন সব শিক্ষা অফিসারদের গাফলতি তদারকি করা প্রয়োজন বলে মনে করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ অভিভাবকরা। পাশাপাশি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর নতুন একাডেমিক ভবন বরাদ্দের ক্ষেত্রে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগের বিষয়টি মাথায় রেখে ওয়াশব্লকসহ পূর্ণাঙ্গ ভবনের প্ল্যান বা প্রকল্প নেয়ার দাবি উঠেছে।

১২ অক্টোবর, ২০২১।