চাঁদপুর রোটারী ক্লাবের অভিষেক অনুষ্ঠিত

মানবসেবার জগতে রোটারী এক বৃহৎ পরিবার
…..খাদ্য সচিব মো. ইসমাইল হোসেন

এস এম সোহেল
খাদ্য সচিব ও চাঁদপুরের সাবেক জেলা প্রশাসক মো. ইসমাইল হোসেন বলেছেন, মানবসেবার জগতে রোটারী এক বৃহৎ পরিবার। সেবা স্বার্থের ঊর্ধ্বে এই মূলমন্ত্রের মাধ্যমে রোটারী আন্দোলন আজ সবার কাছে সুবিদিত হয়ে উঠছে। করোনাকালীন সময় চাঁদপুর রোটারী ক্লাব অক্সিজেন সিলিন্ডার সরবরাহ করে করোনার রোগীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাদের এই মহতী উদ্যোগকে আমি অভিনন্দন জানাই, আর্তমানবতার সেবায় নিবেদিত মহান রোটারিয়ানদের প্রতি আমি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
তিনি গত বৃহস্পতিবার (৮ ডিসেম্বর) চাঁদপুর পুরাণবাজার ডিগ্রি কলেজ প্রাঙ্গণে চাঁদপুর রোটারী ক্লাবের ৫২তম অভিষেক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন। অভিষেক অনুষ্ঠানে ক্লাবের ২০২২-২৩ রোটারী বর্ষের বোর্ড অব ডিরেক্টর্সের সদস্যরা অভিষিক্ত হন।
খাদ্য সচিব মো. ইসমাইল হোসেন তার বক্তব্যে বলেন, আপনারা চিন্তা করে দেখেছেন, আমরা আমাদের সন্তানদের নিজের কাজ নিজে করতে শিখাচ্ছি কিনা। আমরা আমাদের সন্তানদের অলস বানিয়ে ফেলছি। তা থেকে বের হয়ে আসতে হবে, অন্তত নিজের কাজগুলো করতে শিখাতে হবে। আমাদের সুষ্ঠু সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করতে হবে। আমাদের সন্তানদের কাছে আমাদের সংস্কৃতি, দেশ, স্বাধীনতার বিষয়ে গল্প করতে হবে। তাদের সংস্কৃতি, দেশ, স্বাধীনতার বিষয়ে শিক্ষা দিতে হবে। তাহলেই দেশ এগিয়ে যাবে। তাদের শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করাতে হবে। যাতে তারা ‘৪১ নয় আরো পরবর্তীতে ২১শ’ সালের জন্য তাদের তৈরি করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, আমাদের দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে হবে। আমাদের সন্তানরা ইংরেজি বলতে গেলে পারে না। কিন্তু আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে নিজের ভাষার বাইরে ইংরেজি আরো কয়েকটি ভাষা শিখছে। তারা যাতে কর্মক্ষেত্র কোন জায়গায় আটকে না যায়। আমাদের জীবন চালানোর ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে হবে। বৈপ্লবিক পরিবর্তন করতে হলে ৫০ বছরের আগে করতে হবে। মেরাথন রেইসের মতো আমাদের চিন্তা করে আগাতে হবে, তা না হলে আমরা পিছিয়ে যাবো। সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আমাদের মেয়েদের অনেক অগ্রগতি হয়েছে। আরো অনেকদূর যেতে হবে। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি আপনি যদি সামাজিক পরিবর্তনের জন্য কিছু করতে চান তাহলে করতে পারবেন। আগে আপনার মানসিকতা ঠিক করতে হবে। তাহলে সব সহজ হয়ে যাবে। কোন কিছু বাধা হবে না। আমাদের ছেলে-মেয়োরা পৃথিবী জয় করতে পারে, তারা আনেক মেধাবী। তাদের পরিচর্যা করা প্রয়োজন। তাদের মধ্যে আত্মবিশ^াস তৈরি করে দিতে হবে। নতুন চিন্তা করে নতুনভাবে এগিয়ে যেতে হবে। আমি আশা করি চাঁদপুর রোটারী ক্লাবের মাধ্যমে নতুন দিগন্ত খুলবে এবং চাঁদপুর এগিয়ে যাবে। কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি আমাকে দাওয়াত করে আমার পুরোনো মুখ এবং পুরোনো স্থানগুলো পরিদর্শনের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।
পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত, শ্রীমদ্ভাগবত গীতা পাঠ, ত্রিপিটক পাঠ এবং জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করেন রোটা. অ্যাড. মো. শাহাদাত হোসেন, পবিত্র গীতা পাঠ করেন রোটা. গোপাল চন্দ্র সাহা এবং পবিত্র ত্রিপিটক পাঠ করেন রোটা. ডা. পীযূষ কান্তি বড়ুয়া।
৫২তম অভিষেক অনুষ্ঠানের চেয়ারম্যান রোটা. পিপি কাজী শাহাদাতের পরিচালনায় ও বিদায়ী সভাপতি রোটা. শাহেদুল হক মোর্শেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত প্রথম অধিবেশনে ক্লাবের নিয়মিত সাপ্তাহিক সভা শুরু হয়। সভায় ২০২১-২২ বর্ষের বার্ষিক প্রতিবেদন পেশ করেন ক্লাবের বিদায়ী সেক্রেটারী রোটা. অ্যাড. পলাশ মজুমদার এবং তাদের কার্যকালে ক্লাবের সেবামূলক কাজে বিশেষ অবদান রাখায় ক্লাবের ক’জনকে বিশেষ উপহার প্রদান করা হয়। প্রথম অধিবেশনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে ক্লাবের বিদায়ী সভাপতি রোটা. শাহেদুল হক মোর্শেদ ২০২২-২৩ রোটারী বর্ষের নবাগত সভাপতি রোটা. খোরশেদ আলম পাটওয়ারী কাঞ্চন ও বিদায়ী সেক্রেটারী রোটা. পলাশ মজুমদার ২০২২-২৩ রোটারী বর্ষের নবাগত সেক্রেটারী রোটা. ডা. পীযূষ কান্তি বড়ুয়ার কাছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রোটারী কলার হস্তান্তর করেন। পরবর্তী সময় ২০২২-২৩ রোটারী বর্ষের নবাগত সভাপতি রোটা. খোরশেদ আলম পাটওয়ারীর সভাপতিত্বে ৫২তম অভিষেক অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু হয়।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন জেলা প্রশাসক কামরুল হাসান, পুলিশ সুপার মো. মিলন মাহমুদ ও চাঁদপুর পৌরসভার মেয়র জিল্লুর রহমান জুয়েল। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ইসমাইল হোসেনের সহধর্মিণী প্রফেসর রাশেদা আক্তার গাজী, চাঁদপুর সেন্ট্রাল রোটারী ক্লাবের পাস্ট প্রেসিডেন্ট রোটা. শেখ মনির হোসেন বাবুল ও চাঁদপুর জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাড. কামাল উদ্দিন আহমেদ শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন। প্রধান অতিথির জীবনী তুলে ধরেন পিপি রোটা. তমাল কুমার ঘোষ।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখায় এদিন জেলা প্রশাসক কামরুল হাসান, স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত নারী মুক্তিযোদ্ধা ডা. সৈয়দা বদরুন্নাহার চৌধুরী, মুক্তিযুদ্ধের মহান সংগঠক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব জীবন কানাই চক্রবর্তী এবং পুরানবাজার ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদারকে সম্মাননা জানানো হয়। ডা. সৈয়দা বদরুন্নাহারের অসুস্থতার কারণে তার পক্ষে ক্রেস্টগ্রহণ করেন চাঁদপুর রেলওয়ে কিন্ডারগার্টেনের অধ্যক্ষ রোটা. মাহমুদা খানম এবং একই কারণে জীবন কানাই চক্রবর্তীর ক্রেস্ট গ্রহণ করেন তাঁর বড় ছেলে বিপ্লব চক্রবর্তী। এছাড়া রোটারীর মাধ্যমে সমাজসেবামূলক কাজে অনবদ্য অবদান রাখায় চাঁদপুর রোটারী ক্লাবের পাস্ট প্রেসিডেন্ট রোটা. আলহাজ মো. জাহাঙ্গীর আখন্দ সেলিম ও রোটা. সুভাষ চন্দ্র রায়কে আজীবন সম্মাননা ক্রেস্ট প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানে চাঁদপুর সদর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মুহম্মদ আব্দুর রশিদ এবং প্রখ্যাত বিতর্ক সংগঠক ইবনে আজম সাব্বিরকে সম্মাননা ক্রেস্ট প্রদান করা হয়। এদের সবার হাতে সম্মাননা ক্রেস্ট তুলে দেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি মো. ইসমাইল হোসেন।
অনুষ্ঠানে ক্লাবের জয়েন্ট সেক্রেটারী রোটা. মাহবুবুর রহমান সুমনকে রোটারী ফাউন্ডেশনে অনুদান প্রদানের জন্য রোটারী ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক প্রদত্ত এমপিএইচএফ পিন পরিয়ে দেন ক্লাব সভাপতি রোটা. খোরশেদ আলম পাটওয়ারী কাঞ্চন ও আইপিপি রোটা. শাহেদুল হক মোর্শেদ।
দীর্ঘ সময় ধরে অনুষ্ঠিত অভিষেক অনুষ্ঠানটি প্রাণোচ্ছলতায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠে। অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে সুসজ্জিত বিশাল আকারের ছাউনিটি কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে যায় অনুষ্ঠান শুরুর প্রাক্কালে। অনুষ্ঠানে চাঁদপুর সেন্ট্রাল রোটারী ক্লাব, চাঁদপুর হিলশা সিটি রোটারী ক্লাব, চাঁদপুর রোটার‌্যাক্ট ক্লাব, মতলব রোটারী ক্লাব, ফরিদগঞ্জ রোটারী ক্লাবের সদস্যবৃন্দ এবং বিভিন্ন স্থান থেকে আগত রোটারিয়ান ও তাদের পরিবারবর্গসহ সুধীজনদের উপস্থিতিতে মিলন মেলায় পরিণত হয়। তারা প্রতীকী বিশ্বকাপ ফুটবল খেলে, শীতের পিঠা ও রাতের খাবার খেয়ে নিজেদের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। মূল অনুষ্ঠান শুরুর আগে রোটারিয়ান পরিবারবর্গের মাঝে অনুষ্ঠিত হয় মিনি বিশ্বকাপ ফুটবল প্রীতি ম্যাচ। খেলাটি পরিচালনা করেন রোটা. অ্যাড. শাহাদাত হোসেন ও রোটা. রফিকুল ইসলাম রফিক। আর মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী রোটা. নাছির উদ্দিন খান, রোটা. মাহমুদা খানম, স্বজন সাহা, প্রীতি রাণী সাহা, প্রত্ন পীযুষ, প্রখর পীযূষ প্রমুখ। এছাড়া মনোজ্ঞ নৃত্য পরিবেশন করেন শিশুশিল্পী নূপুর ও সাফা এবং সামিয়া বিনতে জাকির। পরে বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন চাঁদপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি রোটা. গিয়াসউদ্দিন মিলন, সাধারণ সম্পাদক রিয়াদ ফেরদৌস, রোটা. জাকির হোসেন, রোটা. পিপি অ্যাড. সাইয়েদুল ইসলাম বাবু, রোটা. পিপি নাছির উদ্দিন খান প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে রোটারী ডিস্ট্রিক্ট-৩২৮২-এর ডেপুটি গভর্নর রোটা. পিপি অ্যাডভোকেট সাইয়েদুল ইসলাম বাবু ও অ্যাসিস্টেন্ট গভর্নর রোটা. পিপি নাছির উদ্দিন খান তিনজনকে যথাক্রমে প্রত্যয় পাঠ ও পিন পরিয়ে চাঁদপুর রোটারী ক্লাবে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন। এরা হচ্ছেন : মহসিন ভূঁইয়া, ফয়সাল ফরাজী ও রুবেল।
উল্লেখ্য, ১৯৭০ সালের ২০ নভেম্বর চাঁদপুর রোটারী ক্লাবের শুভ সূচনা হয়। চাঁদপুর রোটারী ক্লাবের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে চাঁদপুর শহর তথা এ অঞ্চলে রোটারীর পথচলা শুরু হয়েছিলো। ইতোমধ্যে চাঁদপুর রোটারী ক্লাব চাঁদপুর জেলাসহ পার্শ্ববর্তী জেলায় নানা সেবামূলক কাজের মাধ্যমে রোটারী অঙ্গনে একটি বিশেষ স্থান দখল করেছে।

১২ ডিসেম্বর, ২০২২।