———-অধ্যাপক মো. হাছান আলী সিকদার———-
৬০ দশকের দীর্ঘ বাঙালি জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম-স্বাধীকার আন্দোলন-স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মহান মুক্তিযুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকার উত্তরাধিকার ধারণ করে বামপন্থী ঐতিহ্যের মধ্যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্তরে স্তরে সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার শ্লোগান এবং সুমহান জাতীয় মুক্তির আন্দোলন ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ বাংলাদেশের যুবসমাজ মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনার ভিত্তিতে দেশ গঠনের সংগ্রাম বেগবান করতে ১৯৭২ সালের ৩১ শে অক্টোবর গঠন করেছিলেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জাসদ।
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই জাসদ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে গণআন্দোলন পরিচালনা করে আসছে। গণআন্দোলনের এ পথে জাসদের হাজার হাজার নেতা-কর্মী আত্মবলীদান-অত্যাচার-নির্যাতন-কারাভোগসহ সীমাহীন ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকার করেছেন। সংগ্রামের সেই চেতনাকে ধারণ করে জাসদ আজও জঙ্গিবাদ ও জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষকদের মোকাবেলার পাশাপাশি রাজপথ-সংসদ-সরকারে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সমাজ পরিবর্তনের জন্য সোচ্চার ভূমিকায় অবতীর্ণ আছে এবং সংগ্রামের চেতনায় আজ ৩১ অক্টোবর ২০১৮ দলের ৪৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করছে। এ বছর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর প্রতিপাদ্য বিষয় বা স্লোগান- ‘নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র রুখে দাঁড়াও; সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শান্তি-উন্নয়নের ধারা এগিয়ে নাও; দুর্নীতি ও বৈষম্যের অবসান কর; সুশাসন ও সমাজতন্ত্রের পথ তৈরি কর।’
স্বাধীনতা লাভের অব্যাবহিত পরই সমাজতন্ত্রের ব্যাখ্যা ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পন্থা সম্পর্কে ছাত্রলীগ নেতৃত্বের মধ্যে মতবিরোধের সৃষ্টি হয়ে ১৯৭২ সালের মে মাসে সংগঠন দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। একদিকে ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী ও ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখন মুজিববাদের ভিত্তিতে রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের পক্ষে মত প্রকাশ করেন। অপরদিকে ডাকসুর সহ-সভাপতি আ.স.ম. আবদুর রব এবং ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের একটি অংশ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ভিত্তিতে দেশ গড়ার আহ্বান জানায়। পরে রব সমর্থিত ছাত্রলীগের ৩ জন নেতা আ.স.ম. আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজ ও শরীফ নূরুল আম্বিয়া সংবাদপত্রে বিবৃতির মাধ্যমে দাবী জানান, দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে গণপরিষদ ও মন্ত্রিসভা বাতিল করা হোক এবং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বিপ্লবী জাতীয় সরকার গঠন করা হোক। অপরদিকে নূরে আলম সিদ্দিকী, আব্দুল কুদ্দুস মাখন ও ইসমত কাদির গামা পাল্টা বিবৃতিতে গণপরিষদ ভেঙ্গে দেয়ার দাবীর প্রতিবাদ করে। সংগঠন ও আদর্শগতভাবে ছাত্রলীগ দু’অংশে বিভক্ত হয়ে গেলেও প্রথম দিকে উভয় অংশই শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আস্থাশীল ছিল। পরে রব সমর্থিত ছাত্রলীগ শেখ মুজিবুর রহমানের উপর সমর্থন প্রত্যাহার করে এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৭২ সালে ৩১শে অক্টোবর আ.স.ম. আব্দুর রব ও শাজাহান সিরাজের উদ্যোগে জাসদ গঠিত হয়। ২৩শে ডিসেম্বর দলের প্রথম জাতীয় সম্মেলনে মেজর জলিল সভাপতি, আ.স.ম. আব্দুর রব সাধারণ সম্পাদক এবং শাজাহান সিরাজ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
জাসদের জন্ম হয়েছিল সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিয়ে, বিপ্লবী পথে। প্রতিষ্ঠাকালীন প্রেক্ষিত ছিল সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের মাঝে বেড়ে উঠা সাম্য তথা শোষণমুক্ত সমাজ নির্মাণের আকাঙ্খা। তখন বিশ্বে চলছিল সমাজতন্ত্র ও জাতিগত আত্মনিয়ন্ত্রণের অনুরণন। আর বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম ছিল না। বিজয়ী মুক্তি সংগ্রামের পর দেশ গড়ার নীতিতে জাতীয় সরকার গঠনের দাবি যখন প্রত্যাখ্যাত হল তখন মুক্তি সংগ্রামের অন্যতম চালিকাশক্তি যুব সমাজের সঙ্গে সরকারের ব্যবধান তৈরি হল। কোনরকম সাংগঠনিক পদক্ষেপ বা কর্মকৌশল দিয়েও এই ব্যবধান তদানীন্তন রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ দূর করার চেষ্টা করেননি। ফলে জনমনের আকাঙ্খা ধারণ করে প্রগতিশীল একটি রাজনেতিক দলের জন্ম ছিল অবধারিত। একদিকে সরকারের অসহিষ্ণু চাপ, অপরদিকে সনাতনী সমাজতান্ত্রিক দলগুলোর সাথে আদর্শগত বিতর্ক মোকাবেলা করে ‘জাসদ’কে নিজ পায়ে দাঁড়াতে হয়েছিল।
৪৬ বছরের যাত্রাপথে জাসদকে নানা চড়াই-উৎরাই তথা সংগ্রাম-চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে পার হতে হয়েছে। আমাদের অগ্রজ নেতৃবৃন্দ গত শতাব্দীর ষাটের দশক থেকেই বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন করার নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে একনিষ্ঠভাবে ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক দলের মাঝে কাজ করে গেছেন। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ নামের নিউক্লিয়াস ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাণকেন্দ্র। ১৯৬৬ সালে যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন তখন অগ্রজ নেতৃবৃন্দই তাকে বাংলার মানুষের দাবি হিসেবে বাংলার ঘরে ঘরে প্রতিষ্ঠিত করেন। সে সময় নিউক্লিয়াসের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রের আকাঙ্খা তৈরি হয়। যা ১৯৭০ সালে ‘স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ’ এর প্রস্তাব হিসেবে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে পাশ হয়। ১৯৭০ সালের ১২ই আগস্ট ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় তৎকালীন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য চট্টগ্রামের স্বপন কুমার চৌধুরী ‘স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। সভায় উপস্থিত ৪৫ জনের মধ্যে ৩৬জন প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেন। বিপক্ষে ভোট দেন নূরে আলম সিদ্দিকী, আব্দুল কুদ্দুস মাখন ও শেখ শহীদুল ইসলামসহ ৯ জন। স্বাধীনতা আন্দোলনের ধারায় ‘স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার বিষয় স্পষ্টতর হতে থাকে। ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঘোষিত স্বাধীনতার ইশতেহার বা স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের ঘোষণা ও কর্মসূচিতে বলা হয়, ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠন করে অঞ্চলে অঞ্চলে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বৈষম্য নিরসনকল্পে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি চালু করে কৃষক-শ্রমিক রাজ কায়েম করতে হবে।’ এর প্রেক্ষিতে ১৯৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সমাজতান্ত্রিক আকাক্সক্ষা নিয়ে ছাত্রলীগ বিভক্ত হয় এবং পরবর্তীতে ১৯৭২ সালের ৩১শে অক্টোবর গঠিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজনৈতিক দল তথা প্রথম বিরোধী দল- ‘জাসদ’।
শুরু থেকেই জাসদ সমাজতন্ত্র নির্মাণে দল গড়ে তোলার উপর মনোনিবেশ করেছিল। নিরূপণ করা হয়েছিল, দেশটিতে পুঁজিবাদী এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অসম্পূর্ণ। ক্ষমতাসীন পুঁজিপতি শ্রেণীকে উচ্ছেদ করতে হবে বিপ্লবের মাধ্যমে। বিপ্লবী শ্রেণী ও দল ক্ষমতায় আসলে মুক্তিযুদ্ধের অসম্পূর্ণতা পূরণ করা যাবে। জাসদ চেয়েছিল, এ দেশের ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকাঠামো-অর্থনীতি-প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রভৃতিকে স্বাধীন দেশের উপযোগী করে ঢেলে সাজাতে। জাতির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে এ মহাকর্তব্য পালনে সর্বময় ক্ষমতা দেবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন জাসদ নেতৃত্বই। কিন্তু একদিকে কায়েমী স্বার্থবাদী শক্তির ষড়যন্ত্র, পরাজিত স্বাধীনতা বিরোধীরা ভোল পাল্টে ‘কমিউনিস্ট ঠেকাও’ শ্লোগান দিয়ে ক্ষমতাসীনদের সুহৃদ সেজে দেশকে পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক ধারায় চলতে দেবার জন্য নানা চক্রান্ত আঁটে। ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক অবিমৃষ্যকারীতা দেশকে লুটেরা পুঁজিবাদী ধারায় নিয়ে যায় যা দেশকে আবারো পুরানো ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণে নিক্ষেপ করে। ইতোমধ্যে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীরা সংগঠিত হবার সময় পায় ও ক্ষমতাসীনদের পরিস্থিতি মোকাবেলায় দুর্বলতা, নানা ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও গণবিচ্ছিন্নতার সুযোগে বঙ্গবন্ধুকে স-পরিবারে হত্যার মাধ্যমে সামরিক ক্যুদেতা সংগঠিত করে। যে ষড়যন্ত্রে খন্দকার মুশতাকের নেতৃত্বে অনেক আওয়ামী লীগ নেতা জড়িত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা প্রক্রিয়ায় যা আজ সকলেই স্পষ্টভাবে অবহিত। বঙ্গবন্ধু হত্যায় জাসদ রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়; রাজনৈতিক আন্দোলন করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। খন্দকার মুশতাক এবং খালেদ মোশারফের সরকার কোন রাজনৈতিক সরকার ছিল না। ছিল ষড়যন্ত্রমূলক কর্তৃত্ব। দেশ পুরোপুরি পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক সামরিক শাসনের ধারায় সামিল হয়।
পরিস্থিতি যখন চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে তখন ৭ই নভেম্বর জাসদের সম্মতি ও কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়। উক্ত সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থানের বিজয় জাসদ নেতৃত্ব ধরে রাখতে পারেনি। জেনারেল জিয়া দেশী-বিদেশী সহযোগিতায় ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি’ নামে প্রতিবিপ্লব সংগঠিত করেছে, অর্ডিনেন্স দিয়ে সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তন করেছে, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল জামাত-মুসলিম লীগ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে এবং নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের মাধ্যমে নিজের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য বিএনপি গঠন করেছে। জাসদ নেতাদের পুনরায় জেল দিয়েছে, বীর মুক্তিযুদ্ধা কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি দিয়েছে। এর পরে উপর্যুপরি জিয়া-এরশাদের সামরিক শাসনের দীর্ঘ কালো রাজনীতির কথা আমরা সবাই জানি। তবুও কিছু উল্লেখ না করলেই নয়।
’৭৫-এর ১৫ই আগস্ট ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে মোশতাক-জিয়া চক্র যে রাজনৈতিক ও কলঙ্কময় অপরাধ সংঘঠিত করে তার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি দিক হলো- অবৈধ ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে সংবিধান লঙ্ঘন, সামরিক শাসন প্রবর্তন, সংবিধানের মূলনীতির পরিবর্তন, যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী কাজ সংগঠিতকারীদের পুনর্বাসিত করা, সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় রাজনীতির সুযোগ সৃষ্টি, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজনীতি করার অনুমতি প্রদান, পাকিস্তানী ভাবধারা ও রাজনৈতিক দর্শনের পুনঃপ্রবর্তন।
জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও রাষ্ট্রবিরোধী অবস্থান গ্রহণ এবং তার ক্ষমতা ক্রমান্বয়ে সুসংহত করেন। বাঙালি জাতির দীঘ সংগ্রামের অর্জিত সকল গৌরবকে তিনি ধূলোয় মিশিয়ে দেন। জাতীয় চেতনা বিরোধী সুদূরপ্রসারী এক সর্বনাশা রাজনৈতিক কর্মপন্থা তিনি চালু করন। ১৯৭৯ সালে জেনারেল জিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংসদের প্রথম অধিবেশনে ৫ম সংশোধনী দিয়ে ১৫ই আগস্টের বঙ্গবন্ধু হত্যা, কর্নেল তাহের হত্যা, জেলখানায় চার নেতা হত্যাসহ সব অপকর্মের হোতাদের দায়মুক্তি প্রদান করেন। পাকিস্তানপন্থী ও রাজাকারদের মন্ত্রী পরিষদে অধিষ্ঠিত করার ঘৃণ্য পথ অনুসরণ করেন। জাতীয় সংহতির নামে রাজাকার-মুক্তিযোদ্ধাদের একই সমতলে রাখার জিয়ার নীতি বাস্তবে পরিণত হয়েছিল পরাজিত মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তিকে রাজনীতি, প্রশাসন ও সেনাবাহিনীতে মদদ দান। মুক্তিযোদ্ধারা এবং দেশপ্রেমিক জনগণ তার এই নীতি গ্রহণ করেনি।
জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্রপতি সাত্তারকে অবৈধভাবে উচ্ছেদ করে ক্ষমতা দখল করে একই পথে চলতে থাকেন এবং জিয়ার সার্থক উত্তরসূরী হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে সক্ষম হন। তার সময় গোলাম আযমের নাগরিকত্ব প্রদান, সংবিধানের ৮ম সংশোধনী দিয়ে রাষ্ট্র ধর্ম আরোপ করা, মুক্তবাজার অর্থনীতি শক্তিশালী করার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা, প্রশাসনে সামরিক আমলাদের কর্তৃত্ব অব্যাহত রাখা ছিল উল্লেখযোগ্য বিষয়। উপজেলা পরিষদ গঠন ও ক্ষমতায়ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলেও এরশাদের অধীনে এ সকল নির্বাচন ছিল বিতর্কিত ও অগ্রহণযোগ্য।
‘জাসদ’ অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী জেনারেল এরশাদকে গ্রহণ করেনি এবং রাজনীতিতে অসংবিধানিক হস্তক্ষেপ অবসান কল্পে আপোষহীন সংগ্রাম গড়ে তুলেছিল। যে উদ্যোগের অংশ হিসেবে ১৫ দলীয় জোট, ৭ দলীয় জোট এবং পরবর্তী পর্যায়ে ৮ দল, ৫ দল ও ৭ দলীয় জোট গড়ে উঠেছিল। অবশেষে ডা. মিলন, শাজাহান সিরাজসহ অনেকের আত্মদানের মাধ্যমে এরশাদ সরকারের পতন হয়।
সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে পূর্ণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এই সংগ্রামে নেতৃত্বের একাংশ বিভ্রান্ত হয়ে সাম্যবাদী দল গঠনকল্পে বাসদ, আর এক অংশ (আ.স.ম. রবের নেতৃত্বে) জাসদ নামে এরশাদের অনুগত বিরোধী দল সাজে। এসব ঘটনা জাসদের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হলেও ছাত্র, শ্রমিক, পেশাজীবী এবং যুব সম্প্রদায়ের সমর্থন নিয়ে জাসদ ৯ বছরের আন্দোলনে প্রভূত শক্তি সঞ্চয় করে এবং সংগ্রামে অবদান রাখতে সক্ষম হয়। এমনকি সংগ্রামের শেষকালে শাজাহান সিরাজ ও মীর্জা সুলতান রাজার সুবিধাবাদী অবস্থান জাসদের এই অগ্রযাত্রা থামাতে পারেনি।
এরশাদ সরকার সংবিধানের ৮ম সংশোধনী আরোপ করলে জনমনে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী নানা ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা ফুঁসতে থাকেন। পরবর্তীতে অর্থাৎ ১৯৯২-এর ২৬শে মার্চ গণআদালতে গোলাম আযমের বিচার হয় এবং ক্রমান্বয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ঐক্য দৃঢ় হতে থাকে; যা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে পরিণত হয়ে গণতন্ত্রের সংগ্রাম সমৃদ্ধ হয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে সংগঠিত করার বহুমুখী তৎপরতায় তদানীন্তন জাসদ সভাপতি কাজী আরেফ এর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
’৯০-এর আন্দোলনের মধ্যমে জাসদের যে শ্রমজীবী পেশাজীবীদের মধ্যে ও ছাত্রসংসদে যে সংগঠন গড়ে উঠেছিল তা সরকারের হীন চক্রান্তমূলক কর্মসূচির প্রভাবে দুর্বল হতে থাকে। দলের জন্য এটা একটা খারাপ সময়। তবুও গণতন্ত্রের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে জাসদ ’৯৬ সালে অনুষ্ঠেয় খালেদা জিয়ার সাজানো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। পেশাজীবী সংগঠনসমূহে বিদ্যমান শক্তি দিয়ে জাসদ জনতার মঞ্চকে সমর্থন করেছে এবং পরবর্তী যে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়েছে তাতে জাসদ কোন আসন লাভ করেনি। তাই জাসদ কর্মীরা আবেগতাড়িত হয়ে এ সময় ঐক্য-জাসদ আওয়াজ তোলে যা ১৯৯৭ সালে আ.স.ম. আব্দুর রবের গ্রুপ এবং বাসদের একাংশের সঙ্গে ঐক্য হয়। কিন্তু এ ঐক্য জাসদকে কাক্সিক্ষত গতিশীল করেনি। ঐক্যমতের সরকারে আ.স.ম. আব্দুর রব মন্ত্রী ছিলেন; কিন্তু ২০০১ সনের নির্বাচনে জাসদ একক নির্বাচন করে তবে কোন আসন লাভে ব্যর্থ হয়। আর নির্বাচনের পর আ.স.ম. আব্দুর রব কতিপয় সমর্থকসহ দলত্যাগ করেন।
’৯০-এর সামরিক শাসন বিরোধী গণঅভ্যুত্থানে বিজয়ের মধ্য দিয়ে দেশ সংসদীয় গণতন্ত্রের পথে পুনরায় যাত্রা শুরু করে। নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের ধারা তৈরি হয়। কিন্তু ২০০১ সন থেকে দেশ আবার উল্টো পথে হাঁটতে থাকে। বিএনপি-জামায়াতের ৪ দলীয় জোট সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের ধারাকে কবর দিয়ে তাদের ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার পরিকল্পনা দিয়ে এগোতে থাকে। ’৭১-এর ঘাতকদের মন্ত্রীসভায় স্থান দেয়ার মধ্য দিয়ে উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের অভয়ারণ্য তৈরি করে। এজন্য একদিকে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের শারীরিক নির্যাতন, একসঙ্গে ৫০০ স্থানে বোমা ফাটানো, চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র খালাস, আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা করে জননেত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দকে হত্যার চেষ্টা করে। অপরদিকে, সংবিধান আইনকে নিজেদের সুবিধামতো অদল-বদল করে দলীয় অনুগত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে নির্বাচনের মাধ্যমে পুনরায় সরকার গঠন করে সংসদ নির্বাচনকে নীল নকশার নির্বাচনে পরিণত করার অপচেষ্টা চালায় এর ফলে দেশের অসাম্প্রদায়িক-মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সম্পন্ন গণতান্ত্রিক জনগণকে আতঙ্কিত করে তোলে।
এ ধরনের প্রেক্ষাপটে সংসদীয় গণতান্ত্রিকব্যবস্থা অব্যাহত রাখা ও মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তীতে ঔপনিবেশিক বদলের যেসব কর্তব্য সম্পাদন করা যায়নি তা সম্পন্ন করা, মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে যেসব বিকৃতি দ্বারা কলুষিত করা হয়েছে তাকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করা, স্বাধীনতার পরে যে জাতীয় ঐক্যকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া যায়নি তা গড়ে তোলার জন্য ঐতিহাসিক প্রয়োজনে ১৪ দলীয় ঐক্যজোট গড়ে উঠে ও পরবর্তীতে তা নির্বাচনী সমঝোতার মহাজোটে পরিণত হয়। মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করার জন্য ১৪ দল ২১ দফা কর্মসূচি জাতির সামনে তুলে ধরে।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল খালেদা-নিজামী সরকার গঠনের পর থেকেই রাজনীতিতে অশনি সংকেত উপলব্ধি করে প্রতিবাদী আন্দোলনের সূচনা করে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীদের ঐক্যবদ্ধ হবার ডাক দেয়। মুক্তিযুদ্ধের পর ছাত্র-শ্রমিক নেতৃবৃন্দ দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে তোলার যে কর্মসূচি ও জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার ডাক দিয়ে ছিলেন, ১৪ দলের মাধ্যমে সে ধরনের রাজনৈতিক কর্তব্য পালনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হওয়া সম্ভব বলে জাসদ মূল্যায়ন করে। তাই ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন-নির্বাচন-সরকার গঠনের জন্য ১৪ দলকে অঙ্গীকারাবদ্ধ করার বিষয়ে জাসদ প্রধান উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করে। তার ফসল হিসেবে আজ ১৪ দল তথা মহাজোটের সরকার পরপর দু’টার্ম দেশ পরিচালনা করছে।
নানাবিধ বিভ্রান্তি, ১৪ দলের অভ্যন্তরীণ সংহতির অভাব স্বত্তেও জাসদ নীতির প্রশ্নে সরকারকে দৃঢ়তার সঙ্গে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। নীতির প্রশ্নে জাসদ সবসময় অটল ছিল এবং এখন অনেক অভিজ্ঞ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন প্রশ্নে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি দৃঢ় করতে এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় জাসদ অবিচল ছিল। বিপ্লবী অভ্যুত্থান সংগঠিত করতে এবং ষড়যন্ত্রকারী প্রতিবিপ্লবীদের মোকাবেলা করতে জাসদের নেতা-কর্মীরা নির্দ্বিধায় নিজেকে উৎসর্গ করেছেন।
আমাদের কাঙ্খিত সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার জন্য জাতীয় ঐক্য এক অপরিহার্য শর্ত। শুধু শ্লোগানের উপর ভিত্তি করেই জাতীয় ঐক্য হয়না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই হচ্ছে জাতীয় ঐক্যের ভিত। আর তাই শহীদ কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তম এর ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে জাসদ কর্তৃক আয়োজিত আলোচনা সভায় জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘দেশে একটি বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছে এবং স্বাধীনতাবিরোধী, জঙ্গি ও তাদের দোসরদের সাথে কোন আপোষ করা হবে না। একাত্তরে আমরা একটি আদর্শের জন্য লড়াই করেছি এবং পাকিস্তানী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদরেদের সাথে কোন আপোষ করিনি। বাংলাদেশের বর্তমান সমস্যা সমাধানের জন্যও তাদের একাত্তরের মত পরাস্ত করতে হবে।’
সর্বোপরি এই প্রত্যয় নিয়ে ‘জাসদ’ আজ যে কাজটি করতে চায় তা হলো একদিকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে অংশ নেয়া এবং মুক্তিযুদ্ধের শক্তিকে সুসংহত করা, অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী চেতনা প্রতিহত করা (যাতে সরকারে ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল-বিরোধী দলেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল এবং এটাকেই মুখ্য জাতীয় রাজনৈতিক নির্বাচনী এজেন্ডা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা), দুঃশাসন-নীতিহীনতা, দলবাজি-দুর্নীতি, স্বাজনপ্রীতি-বৈষম্যের অবসান, এসবের জন্য দল হিসেবে আপোষহীন শক্তির প্রতীক হয়ে জনগণের সামনে উদ্ভাসিত হওয়া প্রয়োজন। এখানেই জাসদের সংগ্রাম-ঐতিহ্যের ভূমিকা বারবার উজ্জ্বল করে এবং দ্বিধাহীনভাবে নিঃশঙ্কচিত্তে এগিয়ে যেতে চায় অভিষ্ঠ্য লক্ষ্যে।
লেখক : সভাপতি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ, চাঁদপুর জেলা শাখা, শিক্ষক নেতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রনেতা।