নবী নোমান
ফরিদগঞ্জ পৌরসভার এসোসর/ক্যাশিয়ার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) গিয়াস উদ্দিন সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। আছে নগদ টাকাসহ গ্রামের বাড়ি রায়পুরে বিলাশবহুল বাড়ি ও দোকানপাটসহ বহু ক্রয়কৃত সম্পত্তি। নামে-বেনামে আছে ব্যাংকে টাকা।
ফরিদগঞ্জে চাকরির ১৬ বছরে মেয়রদের ব্যবহার করে তিনি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে যান। বিশেষ করে মেয়র আবুল খায়ের পাটওয়ারীর ছত্রছায়ায় পৌরসভার একাউন্টগুলো খালি করে কৌশলে কোটি কোটি টাকা ভুয়া প্রকল্পের নামে লুটে নেন ক্যাশিয়ার গিয়াস ও মেয়র, মেয়রের মেয়ে ও আত্মীয়-স্বজনরা এবং মাস্টাররোলের মাস্তান চক্র। পৌর বাজার ও বাসস্ট্যান্ডে টেন্ডার দিয়ে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে গিয়াস ও তার অনুসারীরা পৌর ফান্ডে সামান্য কিছু টাকা জমা দিয়ে বাকি টাকা লুটে নেয়।
বিভিন্ন সময় নৌকা মার্কা চাওয়া ও আওয়ামী লীগের পক্ষে লোক দেখানো ভাব নিয়ে চলতো। পৌরসভার মৃত কর্মচারীর প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা নয়-ছয়, কর্মচারীদের বেতন ও মাস্টাররোলের কর্মচারীদের ছাটাই করে বেতন আত্মসাৎ করে, ২ জন উদ্যোক্তাকে ষড়যন্ত্র করে ছাটাই, বিভিন্ন সময় ভুয়া বিল ভাউচার দিয়ে দলীয় অনুষ্ঠানের টাকা লুট, নামে-বেনামে এবং ভুয়া প্রকল্পের নামে পৌরসভার লাখ লাখ টাকা লুটপাট করে আলোচনায় আসেন তিনি।
পরিবার সূত্রে জানা যায়, তার ২ ছেলে ও স্ত্রীসহ ছোট একটা পরিবার। ছোট ছেলে ফরিদগঞ্জ এআর হাইস্কুলে পড়াশোনা করে। ছোট ছেলে ও স্ত্রীসহ থাকেন ফরিদগঞ্জ ভাড়া বাসায়। বড় ছেলে ঢাকা আহসান উল্লাহ ইউনিভার্সিটিত পড়াশোনা করে। সেখানে ভর্তি হতে খরচ হয় ১ লাখ ৩২ হাজার টাকা এবং প্রতি সেমিস্টার ফি ১ লাখ ২ হাজার টাকা করে খরচ। গড়ে প্রতি মাসে বড় ছেলের পিছনে মাসে ২০-২৫ হাজার খরচ হয়। ৪০ হাজার টাকা বেতনের মধ্যে বড় ছেলের পিছনে মাসে ২০-২৫ হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়। তার ভিআইপি চলাফেরা নানা প্রভাব খাটানোর কারণে পুরো পৌরবাসী এবং পৌর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তার কাছে কোন মূল্যও ছিল না।
ফরিদগঞ্জ পৌরসভায় প্রায় ১৬ বছর চাকরি করে তিনি অঢেল টাকা ও সম্পদের মালিক বনে যান। তিনি তার গ্রামের বাড়ি রায়পুর উপজেলা কেরোয়া গ্রামের দেওয়াজী বাড়ি ও তার আশেপাশে ব্যাপক সম্পত্তির মালিক হন। বাড়ি থেকে সামনে এসে করেন ৪ তলা বিলাসবহুল বাড়ি, প্রধান সড়ক দিয়ে তার গ্রামে ঢুকতে ডানপাশে মার্কেটসহ আছে আরো জমি। তার নামে বেনামে ব্যাংক হিসেবে আছে পৌরসভার লুটের টাকা। গত ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ করার পর গাঢাকা দেন তিনি।
২০০৮ সালে তিনি ফরিদগঞ্জ পৌরসভায় যোগদান করেন। যোগদানের পরই তিনি ফরিদগঞ্জ পৌরসভার নিয়োগকৃত ক্যাশিয়ারের বদলি করান এবং তৎকালীন মেয়রের মাধ্যমে তিনি ক্যাশিয়ার (অঃদাঃ/ভারপ্রাপ্ত) এর দায়িত্বগ্রহণ করেন। অদ্যাবধি তিনি উক্ত পদে বহাল আছেন। তিনি নিজেকে সব ক্ষেত্রে ক্যাশিয়ার পরিচয় দিলে তিনি একজন ছায়া মেয়রের মত ফরিদগঞ্জ পৌরসভার জনসাধারণ ও সব কর্মকর্তা/কর্মচারীদের সাথে আচরণ করেন।
পৌরসভা, উপজেলা প্রশাসনসহ সব প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয় এবং সব কার্যক্রম অনলাইন পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা হলেও ফরিদগঞ্জ পৌরসভায় তা হয় না। ফরিদগঞ্জ পৌরসভায় সব ব্যয়ের চেক বাহক চেকের মাধ্যমে ভাঙানো হয়। সরকারি নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও কোন চেক একাউন্ট পে হয় না। এসব কিছুর পিছনে কারসাজি তিনি। সব কর্মকর্তা/কর্মচারীদের জিম্মি করে রাখেন। যে কর্মচারী তার কথা না শুনবে না তার বিরুদ্ধে মেয়রের কাছে উল্টাপাল্টা নালিশ করে ওই কর্মচারীকে শোকজ, সাময়িক বরখাস্ত- এমনকি বেতন বন্ধের ব্যবস্থা করা হয়।
২০২১ সালে নতুন পরিষদ গঠন হওয়ার পর সরকারি নির্দেশ মোতাবেক মাস্টাররোল কর্মচারী ছাটাই করা হয়। বেশিরভাগের ১০-২০ মাসের বেতন বকেয়া ছিল। বর্তমান পরিশোধের কয়েকজন মাস্টাররোল ছাটাই করেন তারা ৩-৬ মাস পর্যন্ত বকেয়া ছিল। সে টাকাও উত্তোলন করে সে মেরে দেন। এমনি চকিদার মৃত আবুল কাশেমের প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা, মেয়রের নির্দেশ অমান্য করে ৬ বছরেও দেননি।
অফিস সূত্রে জানা যায়, কিছু টাকা বাজার খরচের মত দেয় ক্যাশিয়ার। এখনো ৪ লাখ টাকা পরিবার পাবে, দেই দিচ্ছি এমন করে ঘুরাচ্ছেন ক্যাশিয়ার।
২০২১-২২ অর্থবছরের শেষ সময়ে সরকারি অনুদানকৃত ২৮ লাখ টাকা উত্তোলন করে কর্মচারীদের আনুতোসিক ও ভবিষ্যৎ তহবিলে জমা করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হলেও তিনি তা করেননি। সরকারি বিধির তোয়াক্কা না করে ছোট ছোট ভুয়া বিল ভাউচার (পঁচিশ হাজার টাকার প্রজেক্ট) করে তিনি পৌরসভার অর্থ আত্মসাত করেন বলে জানা যায়। নগর উন্নয়ন প্রকল্পের ৩৫ লাখ টাকা গরমিলের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সব ক্ষেত্রে তার কমিশন বাণিজ্য আছে, পৌরসভার বিল আনতে গেলে মানুষ তার কাছে ভিক্ষুকের মত বসে থাকতে হয়। পৌরসভার ব্যাংক একাউন্ট কয়টি জানতে দেন না কাউকে, এমন কি একাউন্টে সকালে টাকা জমা দিলে বিকালে থাকে না। সবসময় একাউন্ট খালি থাকে। বিভিন্ন সময় প্রকল্পের টাকা চেক দিলে, ব্যাংকে গেলে বাহকরা দেখেন একাউন্টে কোন টাকা নেই। আত্মগোপন থাকা অবস্থায় গত ৮ থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত ব্যাংক থেকে ৫ লাখ ৩৮ হাজার টাকা উত্তোলন করেন।
পৌরসভার আবুল কাশেম, লুৎপুর রহমান, ইসমাইল হোসেন, আব্দুল খালেক, আব্দুল মান্নান, হাবিব উল্ল্যা, আফসার উদ্দিন মোল্লা এই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নামে রাজস্ব তহবিল থেকে ২ লাখ টাকা করে গোপনে লোন নেন ক্যাশিয়ার গিয়াস। পরে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের নামে তাদের প্রয়োজনে রাজস্ব খাত থেকে লোন চাইতে গেলে এই তথ্যগুলো প্রকাশ পায়।
মাস্টার রুলের চাকরি ছেড়ে দেওয়া রোজিনা আক্তার জানান, গত বছর জুলাই মাসের ২৪ তারিখে চাকরি ছেড়ে দিছি। ৬ মাসের বেতন পাবো। ক্যাশিয়ার বেতন দেয় না। দেবো দেবো বলে আর খবর থাকে না। পিংকি নামে আরেক মাস্টার রুলের কর্মচারী ২ মাস ও আছমা আক্তার ৮ মাসের বেতন পাবে, তারাও পাচ্ছে না তাদের বেতন।
আবু তাহের নামে আরেকজন মাস্টার রুলের কর্মচারী (ড্রাইভার পদে) বলেন, আমি ১১ মাসের বেতন পাবো, ক্যাশিয়ার বেতন দিচ্ছে না।
পৌরসভার প্রশিক্ষিত দুই উদ্যোক্তা ফখরুল আলম ও ফারজানা আক্তারকে চাকরিচ্যুত করেন তিনি। এ বিষয়টি জাতীয় ও স্থানীয় বিভিন্ন পত্রিকায় গত ৩০ মে প্রকাশিত হয়।
ক্যাশিয়ারের বিরুদ্ধে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের আজিজ নামে এক যুবক অভিযোগ করলেও দলীয় প্রভাব খাটিয়ে ছাড় পেয়ে যান বলেও অভিযোগ রয়েছে। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে গত ১৬ বছরের সবকিছু খতিয়ে দেখার আহ্বান জানান ছাটাইকৃত কর্মচারী ও সাধারণ পৌর নাগরিকরা।
ভয়ঙ্কর বিষয় হচ্ছে, পৌরসভার কোটি কোটি টাকার সব উন্নয়নমূল কর্মকান্ড ও ক্রয়-বিক্রয়ের ভ্যাট ইনকাম ট্যাক্সের বেশিরভাগ টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা না করে সে তা পকেটে নিয়ে যেতো।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, পৌরসভার কয়েকজন কর্মকর্তা ও কর্মচারী জানান, পৌরসভার ব্যাংক স্ট্যাটমেন্টের সাথে পৌরসভার ক্যাশবই ও বিল ভাউচার খোঁজ নিতে গেলে কোনটার সাথে কোনটার মিল পাওয়া যাবে না।
পৌরসভার বড় বড় টেন্ডারের কাজ ও ঠিকাদারদের যোগসাজশে কাজ ছাড়া বহু প্রকল্পের টাকা তিনি মেয়র ও প্রকৌশলীর সহায়তা লুটে নিতেন।
মেয়রের ঘনিষ্ঠ লোক হিসেবে সে নানা প্রভাব খাটিয়ে কথায কথায পৌরসভার কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মানুষিক ও শারীরিক নির্যাতন করতে তার কোন বাঁধা ছিল না।
তারা জানান, তার অনিয়মের বিষয় কেউ প্রতিবাদ করলে তার বিরুদ্ধে কৌশলে মেয়র বা মাস্টাররোলের কিছু মাস্তানদের তাদের পিছনে লাগিয়ে দিতো। অনেক সময় মেয়রের হাতে অনেকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হওয়ার পরিস্থিতি করে দিতো। অনেক সময় কারণে অকারণে শোকজ নোটিশ করে মানুষিক হয়রানি বা চাকরিচ্যুত করার হুমকি দিতো। এদিকে ক্যাশিয়ার গিয়াস উদ্দিন ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের পরে পালিয়ে রয়েছেন, তার মোবাইলে একাধিকবার কল করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
২৬ আগস্ট, ২০২৪।