‘নিরাপদ মাতৃত্বে আমরা সবাই’ ইনোভেশন কার্যক্রম


হাজীগঞ্জে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে আসুন, সিজার ও জটিলতামুক্ত নরমাল প্রসব করুন!
মোহাম্মদ হাবীব উল্যাহ্
অন্তঃসত্ত্বার সব থেকে বড় ভয় প্রসবকালীন ব্যথা। এই ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে অনেকে নিজ থেকে, আবার অনেকে বেসরকারি ক্লিনিকের অর্থলিপ্সা এবং কিছু চিকিৎসকদের নৈতিকতার ঘাটতিকে দায়ী করে সিজারের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। এভাবে লাগামহীনভাবে বাড়ছে সিজার। চিকিৎসকদের তথ্যানুযায়ী গত দশ বছরে দেশে সিজারের সংখ্যা বেড়েছে পাঁচ গুণের বেশি।
অন্যদিকে বাড়িতে অনিরাপদ প্রসবের কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মা ও শিশু সংক্রমনের শিকার হয়ে থাকে এবং প্রসব পরবর্তী মা ও শিশুর বিভিন্ন জটিলতার সৃষ্টি হয়। এতে একদিকে যেমন বাড়ছে মাতৃমৃত্যুর হার, অন্যদিকে বাড়ছে প্রসব পরবর্তী সময়ে মায়ের শরীরিক নানা জটিলতা এবং আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ততা।
উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের ২০১৭ সালের তথ্য সূত্রে জানা গেছে, উপজেলা সিজারের হার শতকরা ৪১, বাড়িতে ৪৩, অন্যান্য ১০ এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে মাত্র ৬ ভাগ প্রসব বা ডেলিভারী হচ্ছে। এক্ষেত্রে আশংকাজনকহারে সিজারীয়ান প্রসব বেড়ে যাচ্ছে।
প্রসবকালীন এ জটিলতা ও আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ততা থেকে মুক্তি পেতে এবং মা ও শিশুর জীবনের ঝুঁকি এড়াতে গর্ভকালীন সেবা, নিরাপদ প্রসব ব্যবস্থা এবং প্রসবোত্তর সেবা কার্যক্রম জোরদারকরণে ২০১৭ সাল থেকে সম্পূর্ণ নিজস্ব উদ্যোগে ‘নিরাপদ মাতৃত্বে আমরা সবাই’ নামক একটি ইনোভেশন কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে হাজীগঞ্জ উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ।
এ ইনোভেশন কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে- চলতি বছরের জুনের মধ্যে স্যাটেলাইট ক্লিনিক এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের মাধ্যমে দক্ষ পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা কর্তৃক মায়েদের গর্ভকালীন কমপক্ষে ৪ বার চেকআপের হার ৬৫ ভাগ এ উন্নীত করা। এরপর উপজেলায় সিজারের হার শতকরা ৪১ ভাগ থেকে কমিয়ে ২৫ এবং বাড়িতে প্রসব ৪৩ ভাগ থেকে ২৫ এ নিয়ে আসা। এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে নরমাল প্রসব শতকরা ৬ ভাগ থেকে ৩০ এ উন্নীত করা।
এজন্য ব্যাপক কার্যক্রম পরিচালনা করেছে উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- উপজেলার সব গর্ভবতী মায়েদের সঠিক ও নির্ভূল তালিকাকরণ। ওই তালিকাভুক্ত সকল গর্ভবতী মায়েদের ‘প্রেগনেন্ট মাদার রেজিস্ট্রেশন সফট্ওয়্যার’ নামক একটি সফট্ওয়্যারে ডাটা এন্ট্রি দেয়া হয়। সেবাদান কেন্দ্রগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সেবা প্রদানকারীদের দক্ষ করে গড়ে তোলা হয়েছে।
সব ইউনিয়নে ইউনিয়নভিত্তিক স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র এবং ৮টি স্যাটেলাইট ক্লিনিকসহ মোট ৯টি স্থানে মায়েদের উপস্থিতিতে গর্ভকালীণ অন্তত ৪ বার সেবা প্রদান নিশ্চিত করা হয়েছে। এছাড়া গর্ভবতী মাদের নিয়ে নিয়মিত উঠান বৈঠক করা হয়।
গর্ভতালিকা অনুযায়ী সম্ভাব্য প্রসবের তারিখ অনুযায়ী গর্ভবতী মায়েদের সাথে সরাসরি এবং মোবাইলে যোগাযোগ করা হয়। যাতে নিরপাদ প্রসবের জন্য ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে গর্ভবতী মাকে নিয়ে আসা হয় এবং প্রতিমাসে প্রকৃত প্রসবের তালিকা করা হয়। এতে সিজার, বাড়ি, অন্যান্য এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রসহ কে, কোথায় এবং কিভাবে প্রসব করেছেন, তার একটি তালিকা করা হয়। এ বিষয়ে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ এবং প্রসবকালীন সময়ে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে না আসার কারণ চিহ্নিত করা হয়।
গত দেড় বছরে এ ইনোভেশন কার্যক্রমে এসেছে সরকারি সেবার ব্যাপক পরিবর্তন ও অগ্রগতি। যেমন, গর্ভবতী মায়েদের তালিকা ৫০ থেকে ৯০ ভাগ এ উন্নীত, মায়েদের গর্ভকালীন সেবা ৪২ থেকে ৫৩ ভাগ এ উন্নীত, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং সংস্কার ৪০ থেকে ৭৫ ভাগ এ উন্নীত, দক্ষ সেবা প্রদানকারী ৫০ থেকে ৭৫ ভাগ এ উন্নীত, স্থানীয় সরকার ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সম্পৃক্ততা ৪০ থেকে ৯০ ভাগ এ উন্নীত, মায়েদের অবহিতকরণ সভা শূন্য থেকে ৫০ ভাগ এবং ব্যাপক উঠান বৈঠক।
কিন্তু যার জন্য এবং যাদের জন্য এতো আয়োজন, সে আয়োজনে (ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে নিরাপদে প্রসব) আসেনি কাক্সিক্ষত বা টার্গেট অনুযায়ী সফলতা। উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের তালিকা অনুযায়ী জানুয়ারি ২০১৮ হতে এপ্রিল’১৯ পর্যন্ত উপজেলায় ৬২১৮ জন মায়ের প্রসব হয়েছে। এর মধ্যে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে ৭৪১ জন মায়ের প্রসব হয়। অর্জন মাত্র শতকরা ১২ ভাগ।
গত মাসে (এপ্রিল) উপজেলায় ৪১৩ জন গর্ভবতী মায়ের প্রসবের সম্ভাব্য মাস ছিলো। কিন্তু এ মাসে প্রসব হয়েছে ৪১৭ জন মায়ের। যার মধ্যে, সিজারে ১৬৮, বাড়িতে ১৩১, অন্যান্যে ৫৮ এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে ৬০ মা সন্তান জন্ম দিয়েছেন।
টার্গেট অনুযায়ী সফলতা না আসার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে- পারিবারিক অসচেতনতা, বেসরকারি হাসপাতাল ও কিছু চিকিৎসকদের অর্থলোভী মনোভাব এবং নৈতিকতার ঘাটতি। এছাড়া প্রথমবার সিজারিয়ান করার ফলে দ্বিতীয় সন্তান জন্মদানের সময়ও সিজারে বাধ্য করা (যদিও এ ক্ষেত্রে সবার জন্য সিজার প্রযোজ্য নয়)।
যার প্রমাণও এসেছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) এক গবেষণায়। ওই গবেষণায়, সিজারিয়ান অপারেশন সংখ্যা বাড়ার জন্য গবেষকরা বেসরকারি ক্লিনিকের অর্থলিপ্সা, সরকারি ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠু না হওয়া এবং ডাক্তারদের নৈতিকতার ঘাটতিকে দায়ী করছেন।
এ ব্যাপারে উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. গোলাম মোস্তফা জানান, এই ইনোভেশন কার্যক্রমের উদ্দেশ্য হচ্ছে, গর্ভবতী মায়েদের নিরাপদে এবং জটিলতামুক্ত নরমাল প্রসবের ব্যবস্থা করা। এতে একদিকে মায়ের শারীরিক জটিলতা থেকে মুক্তি পাবে, অন্যদিকে আর্থিকভাবে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না এবং মা ও শিশু সুস্থ থাকবে। মা ও শিশু সুস্থ থাকলে, ভবিষ্যৎ সুন্দর হবে।
তিনি বলেন, যদিও প্রসবের ক্ষেত্রে এ পর্যন্ত টার্গেট অনুযায়ী কাক্সিক্ষত ফলাফল আসেনি। তবে, অগ্রগতি হয়েছে। উপজেলায় ২০১৬-১৭ সালে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে ১০-১৫টি প্রসব হতো। সেখানে গত মাসে ৬০ জন গর্ভবতী মা, আমাদের কেন্দ্রে সন্তান জন্ম দিয়েছেন। এছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে অনেক সফলতা এসেছে।
এক প্রশ্নের জবাবে গোলাম মোস্তফা বলেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রসবের জটিলতা দেখা দেয় এবং সিজারের প্রয়োজন রয়েছে। তবে আমাদের দেশে আশংকাজনক হারে সিজারীয়ান প্রসব হচ্ছে। যা মা ও শিশুর শারিরিক জটিলতার সৃষ্টি এবং ওই পরিবার আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, এই ইনোভেশন কার্যক্রম উপজেলা প্রশাসনসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের (ইউপি চেয়ারম্যান) উল্লেখযোগ্য সহযোগিতা পেয়েছি। এ ধারা অব্যাহত থাকলে, ইনশআল্লাহ আমরা সফল হবো। এজন্য তিনি পারিবারিক সচেতনতার বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বৈশাখী বড়ুয়া বলেন, উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের ‘নিরাপদ মাতৃত্বে আমরা সবাই’ নামক ইনোভেশন কার্যক্রমটি প্রশংসনীয়। ইতিবাচক কার্যক্রমে বিশেষ করে জনগণ উপকৃত হবে, এমন কাজে উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতা আছে এবং থাকবে।