ইল্শেপাড় ডেস্ক
মহান ভাষা শহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আজ। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি পূরণের ৭৩ বছর পূর্ণ হচ্ছে এই দিনে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ছিল ঔপনিবেশিক প্রভুত্ব ও শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রথম প্রতিরোধ এবং জাতীয় চেতনার প্রথম উন্মেষ।
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে দুর্বার আন্দোলনে সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত ও রফিকের রক্তের বিনিময়ে বাঙালি জাতি পায় মাতৃভাষার মর্যাদা। রাষ্ট্রভাষার লড়াইয়ে সেদিন রাজপথ রঞ্জিত হয় ভাইয়ের রক্তে। রক্তের ঋণে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ কবিতা লিখলেন। কবিতাটি মোট ৩০ লাইনের। কিন্তু এখান থেকে বেশ কয়েকটি লাইন অমর একুশের কালজয়ী গান হয়ে গেছে।
এই গানটি আজ কোটি কোটি বাঙালি প্রাণের আবেগে দিনভর গাইবেন- ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি/ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু-গড়া এ ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি/আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি।’ এই গানটি প্রজন্মের পর প্রজন্মকে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি চেতনায় আজও অনুপ্রাণিত বাঙালি জাতি। এই কালজয়ী গানের বাণী দেশের মানুষের মনে প্রোথিত হয়েছে সেই থেকে। গানটি পাকি শত্রুদের বিপক্ষে ঘৃণা ক্রোধ আর দ্রোহের আগুন এখনও জ¦ালিয়ে তুলছে।
পাকিস্তানের দোসর রাজাকার, আলবদর ও আলশামসদের বিচারের দাবিতে তরুণ প্রজন্ম রাস্তায় নেমে আসে। শাহবাগে গড়ে উঠে জাগরণ মঞ্চ। এই মঞ্চ এখন গিনেস বুকে স্থান করে নিয়েছে। বিশ্বের আর কোথাও এত দীর্ঘ সময় লাখ লাখ মানুষের জমায়েত হয়নি। একুশের সেই চেতনাই শিক্ষা দিয়েছে কোটি কোটি বাঙালির মেধা ও মননে।
জাতিসংঘ সংস্থা ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ঐতিহাসিক মহান একুশের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার পর থেকে প্রতিবছর আন্তর্জাতিক পর্যায়েও দিবসটি পালিত হচ্ছে।
দিবসটির তাৎপর্য তুলে ধরে দেশের সরকারি-বেসরকারি টেলিভিশন, রেডিও এবং কমিউনিটি রেডিও ব্যাপক অনুষ্ঠানমালা প্রচার করবে। জাতীয় দৈনিকগুলোতে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ঢাকা শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক দ্বীপগুলো এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে বর্ণমালা সংবলিত ফেস্টুন দিয়ে সজ্জিত করা হবে। রাজধানীতে বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, শিশু একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, নজরুল ইনস্টিটিউট, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে শহীদ দিবস উপলক্ষে আলোচনাসভা, সেমিনার, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আবৃত্তি, নান্দনিক হস্তাক্ষর লেখা প্রতিযোগিতা, রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। সকল জেলা ও উপজেলা সদরে দিবসটি পালনের লক্ষ্যে জাতীয় কর্মসূচির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করা হবে। বিদেশে অবস্থিত মিশনগুলোতে শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস যথাযথভাবে উদযাপিত হবে।
একুশের চেতনার ফসল হিসেবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে শহীদ মিনার গড়ে উঠে। প্রতিটি শহীদ মিনার যেন ভাষা শহীদদের অগ্নিশিখা। মাতৃভাষাকে কেবল অসৎ অভিসন্ধির হাত থেকে রক্ষা করেই এ দেশের মানুষ ক্ষান্ত হয়নি, তার জাতিসত্তার পরিচয়কে সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রে এবং শিল্পকর্ম, সঙ্গীত ও নৃত্যে আরও সমৃদ্ধতর করে বাঙালি মননশীলতাকে গতিময় করে তোলে।
ভাষা আন্দোলন তথা একুশে ফেব্রুয়ারি একটি চেতনার নাম। যে চেতনা আমাদের বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশ এবং জাতির মেধা, মনন ও সৃজনশীলতার পথকে বিস্তৃত করেছে। ভাষা আন্দোলনের প্রভাবে সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলাসহ সৃষ্টিশীলতার প্রতিটি ক্ষেত্রে গুণগত ও পরিমাণগত পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।
আমাদের জাতীয় চেতনা বিকাশেও ভাষা আন্দোলনের অবদান অনস্বীকার্য। ভাষা আন্দোলন তার বহুমাত্রিক চরিত্র নিয়ে আমাদের জাতীয় জীবনে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। বাংলা একাডেমি ভাষা আন্দোলনেরই ফসল। বাংলা একাডেমি তাই জাতির মননের প্রতীক হয়ে উঠেছে। জাতীয় আশা-আকাক্সক্ষার সঙ্গে সঙ্গতি বজায় রেখে ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক গুরুত্বকে বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্ম এবং বিশ্বের কাছে তুলে ধরার মূল দায়িত্ব বাংলা একাডেমির। তাই বাংলা একাডেমি ভাষা আন্দোলন জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেছে।
২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫।