সংবাদ প্রকাশে মামলার হুমকি প্রধান শিক্ষকের
স্টাফ রিপোর্টার
চাঁদপুর সদর উপজেলার বাগাদী ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন বাগাদী গণি উচ্চ বিদ্যালয়টি নানা অনিয়মে চলাচ্ছেন প্রধান শিক্ষক এম কামরুল হোসেন। বিদ্যালয়ে এসএসসি ফরম ফিলাপে বেশি টাকা আদায়, অবৈধ সার্টিফিকেটের দায়ে চাকরিচ্যুত অফিস সহকারী পুনঃর্বহাল, ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচনে অনিয়মসহ নানা অভিযোগ পাওয়া যায়। এ নিয়ে অভিভাবক ও এলাকাবাসী চরম ক্ষুব্ধ। যে কোন মুহূর্তে আবারো ঘটতে পারে ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে ২০ টাকা ফি কম দেয়ার কারণে শিক্ষকদের অপমানে ৮ম শ্রেণির ছাত্রী সাথী আক্তারের আত্মহত্যার ঘটনা।
সরেজমিনে বাগাদী গনি উচ্চ বিদ্যালয়ে গেলে বেরিয়ে আসল অনেক গোপন তথ্য। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক, ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ও অভিভাবকরা জানান, এম কামরুল হোসেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর থেকেই অনিয়ম ও নানা অভিযোগের মধ্যে দিয়ে বিদ্যালয়টি শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ফি আদায় করে থাকেন। এ এলাকার শিক্ষার্থীরা অধিকাংশ গরিব ও অসহায়। অভিভাবকরা বেশিরভাগ’ই ক্ষেতে খামারে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। তার উপরে সন্তানদের স্কুলের বেতন ও ফিসহ অন্যান্য বিষয়ে খরচ চালাতে তাদের কষ্ট হয়। প্রধান শিক্ষক এম কামরুল হোসেন নিজেদের ইচ্ছামাফিক গায়ের জোরে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম চালাচ্ছে। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে এসএসসি ফরম ফিলাপে ফি নির্ধারণ করা হয় ৩৪০০-৩৫০০ টাকা। কিছু শিক্ষার্থী ফরম ফিলাপের টাকাও জমা দেয়। অতিরিক্ত ফি আদায় নিয়ে অভিভাবকরা উত্তেজিত হয়ে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়। পরে এক পরীক্ষার্থী অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মো. মঈনুল হাসানকে ফোন করে বিষয়টি জানান। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা কানিজ ফাতেমাকে বিষয়টি দেখার জন্য নির্দেশ দেন। পরে এসএসসি ফরম ফিলাপে ফি নির্ধারণ করা হয় ২০০০ টাকা, যা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ে প্রায় ৪০০ টাকা বেশি। অথচ আগে বেশ কিছু শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে এসএসসি’র ফরম ফিলাপ বাবদ ৩৪০০-৩৫০০ টাকা নেয়া হয়েছিলো। অতিরিক্ত নেয়া টাকা এখনো ফেরত দেয়া হয়নি বলে জানান অভিভাবকরা।
আরো জানা যায়, গত ১৩ অক্টোবর বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভা অনুযায়ী ১৪ অক্টোবর নোটিশ বোর্ডে বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচনের খসরা ভোটার তালিকা সাঁটানো হয়। নিয়ম অনুযায়ী খসরা ভোটার তালিকা ৮ দিন সাঁটানো থাকার কথা। এই ৮ দিনের মধ্যে ৫ কার্যদিবস ভোটার তালিকা আপত্তি ও ৩ কার্যদিবস নিষ্পত্তি, অনুমোদন ও নোটিশ বোর্ডে সংরক্ষণ থাকবে। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন অভিভাবকের নাম ভোটার তালিকায় না থাকায় আপত্তি করেও তাদের নাম ভোটার তালিকায় প্রকাশ হয়নি। ১৪ অক্টোবর ভোটার তালিকা সাঁটানোর পর পূজাসহ সরকারি বন্ধ ছিলো। সে অনুযায়ী ৮ কার্যদিবস শেষ হয় ৩ নভেম্বর। চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করার কথা ৩ নভেম্বর। ১১ নভেম্বর স্থানীয় বেশ কয়েকজন সাংবাদিক বিদ্যালয়ে গিয়ে চূড়ান্ত ভোটার তালিকা সাঁটানোর বিষয় জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক এম কামরুল হোসেন কোন জবাব দিতে পারেননি। সাংবাদিকরা চলে আসার পর প্রধান শিক্ষক চূড়ান্ত ভোটার তালিকা নোটিশ বোর্ডে সাঁটান। যা নিয়ম বহির্ভূত।
এছাড়া অফিস সহকারী ফাতেমা বেগম থাকার পরও তিনি চাকরিচ্যুত একজনকে একই পদে নিয়োগ দেন প্রধান শিক্ষক এম কামরুল হোসেন। অবৈধ সার্টিফিকেটের দায়ে চাকরিচ্যুত ইসমাইল মাস্টার পুনঃনিয়োগ পেয়ে এখন ঐ বিদ্যালয়ে কর্মরত।
এসব বিষয়ে প্রধান শিক্ষক এম কামরুল হোসেনের সাথে কথা বললে তিনি জানান, নিয়মমাফিক বিদ্যালয় পরিচালনা করা হচ্ছে। এসএসসি ফরম ফিলাপ ফি বেশি নেয়ার বিষয়ে বলেন, বোর্ডের ফি ১৬শ’ টাকা, আমরা নিয়েছি ২ হাজার টাকা। অতিরিক্ত টাকার বিষয়ে তিনি বলেন, বিদ্যালয়ের উন্নয়ন ও অনুদান হিসেবে ৪শ’ টাকা নেয়া হয়েছে। সরকারি নিয়োগকৃত অফিস সহকারী থাকা সত্ত্বেও অবৈধ সার্টিফিকেটের দায়ে চাকরিচ্যুত ইসমাইল মাস্টারকে পুনরায় বিদ্যালয়ে নিয়োগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। নিয়োগ দিয়েছেন বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি আরিফ হোসেন চৌধুরী। এসব কিছু প্রতিষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হয়ে বলে প্রধান শিক্ষক এম কামরুল হোসেন জানান।
প্রধান শিক্ষক এম কামরুল হোসেন অন্য অরেকটি বিদ্যালয়ের শিক্ষকের সামনে সাংবাদিকদের হুমকি দিয়ে বলেন এসব বিষয়ে আপনারা সংবাদ প্রকাশ করলে আমি আপনাদের এবং পত্রিকার বিরুদ্ধে মামলা করবো।
বাগাদী ইউপি চেয়ারম্যান আলহাজ বেলায়েত হোসেন বিল্লাল গাজী বলেন, বাগাদী গণি উচ্চ বিদ্যালয়ে বিভিন্ন সময় সরকারি নিয়ম ও বিধির বাইরে বিভিন্ন কাজ করে বলে আমার কাছে অভিযোগ আসে। আমি বিভিন্ন সময় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এম কামরুল ইসলামকে ডেকে সংশোধনের চেষ্টা করে। যারা সরকারের সিদ্ধান্তের পরিপন্থী কাজ করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া দরকার।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মো. মঈনুল হাসন এ বিষয়ে বলেন, বেশ কিছুদিন আগে বাগাদী গণি উচ্চ বিদ্যালয়ের এক পরীক্ষার্থী আমাকে ফোন দিয়ে জানায় তাদের বিদ্যালয়ে এসএসসি ফরম ফিলাপে ফি ৩৪০০-৩৫০০ টাকা করে আদায় করছে। পরে আমি সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কানিজ ফাতেমাকে বিষয়টি দেখার জন্য বলি। কিছুক্ষণ পরে আবার কিছু শিক্ষার্থী জানান, এসএসসি ফরম ফিলাপে ফি পুনঃনির্ধারণ করা হয় ২০০০ টাকা। কিন্তু বেশ কিছু শিক্ষার্থী ফরম ফিলাপ বাবদ ৩৪০০-৩৫০০ টাকা জমা দেয়। তাদের অতিরিক্ত নেয়া টাকা এখনো ফেরত দেওয়া হয়নি বলে তারা জানায়। আমি এই বিষয়টিও নির্বাহী কর্মকর্তা কানিজ ফাতেমাকে দেখার জন্য দায়িত্ব দেই।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে বাগাদী গনি উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির গরিব ছাত্রী সাথী আক্তার জেএসসির মডেল টেস্ট পরীক্ষার নির্ধারিত ফি বাবদ ২৮০ টাকার স্থলে ২০ টাকা কম জমা দেয়। মাত্র ২০ টাকা কম দেয়ায় ঐদিন তাকে বিদ্যালয়ের বাইরে রোদের মধ্যে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রেখে শাস্তি দেয়া হয়। পরদিন সকালে সাথী আক্তার পরীক্ষা দিতে স্কুলে গেলে শিক্ষকরা তাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়। পরে সাথী বাড়িতে গিয়ে শিক্ষকদের অপমানে রাগে ক্ষোভে ঘরের আড়ার সাথে ওড়না পেচিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। ঐ ঘটনায় হত্যার প্ররোচনাকারী বিদ্যালয়ের শিক্ষক জাহাঙ্গীর হোসেনসহ আরো বেশ কিছু শিক্ষক আত্মগোপন করে। এ কারণে কয়েক মাস জাহাঙ্গীর হোসেনের বেতন-ভাতাও বন্ধ ছিলো।
এদিকে গতকাল দৈনিক ইলশেপাড়ে বাগাদী উচ্চ বিদ্যালয়ের সংবাদ প্রকাশ করায় ঐ বিদ্যালয়ের শিক্ষক জাহাঙ্গীর হোসেন সাংবাদিকদের নিয়ে নানা ধরনের কটূক্তি করে। সে বলে, সাংবাদিকরা নাকি বিভিন্ন সময় টাকার জন্য ঐ বিদ্যালয়ে যায়। জানা যায়, এই শিক্ষক জাহাঙ্গীর হোসেন বিভিন্ন তদবির এবং আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে ঐ বিদ্যালয়ে যোগ দেন। তিনি প্রধান শিক্ষকের নানা অনিয়মের অন্যতম সহযোগী।