নিয়ম লঙ্ঘন করে কৃষি জমিতে স্থাপনা!

মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্প এলাকায়

মনিরুল ইসলাম মনির
মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্পের সোনা ফলানো মাটিতে চলছে আবাসনের মহোৎসব। নেই পরিবেশ ইমপেক্ট অ্যাসেসমেন্ট। হচ্ছে না প্রকল্প উন্নয়নে কোনো গবেষণা। অনিয়ন্ত্রিত বাড়িঘর নির্মাণ রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেই।
এখনও সেচ সুবিধা পৌঁছানো সম্ভব হয়নি প্রায় সাড়ে তিন হাজার হেক্টর জমিতে। ৩০ বছরেও সেচের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। কমেছে সেচযোগ্য পাঁচ হাজার হেক্টর এবং অন্যান্য ফসলি জমি চার হাজার হেক্টর। বর্ষা মৌসুমে নিস্কাশনের অভাবে জলাবদ্ধতায় নষ্ট হচ্ছে আরও প্রায় দুই থেকে দেড় হাজার হেক্টর জমির ফসল। ফসল উৎপাদন কমেছে প্রায় ২০ হাজার টন। সেচ কর বকেয়া পড়েছে প্রায় ৮ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেচ প্রকল্প মেঘনা-ধনাগোদায় কৃষি জমিতে সরকারি নিয়ম লঙ্ঘন করে ব্যাপকহারে অনিয়ন্ত্রিত বাড়িঘর নির্মাণের কারণে আবাদি জমি কমে গেছে। গত এক যুগে প্রকল্পে অন্তত পাঁচ হাজার হেক্টর কৃষিজমিতে আবাসন গড়ে উঠেছে। আবাসনের সঙ্গে অনিবার্য রাস্তাঘাট এবং বাজারও তৈরি হয়েছে। প্রকল্প এলাকায় ফসলি জমিতে এভাবে লাগামহীন এবং অপরিকল্পিতভাবে ঘরবাড়ি তৈরি অব্যাহত থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এ সেচ প্রকল্পটি ‘আবাসন প্রকল্পে’ রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্প কর্তৃপক্ষ।
চাঁদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড ও মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮৮ সালে প্রায় ৪শ’ কোটি টাকা ব্যয় করে চাঁদপুর জেলার মতলব উত্তর উপজেলার ১৪টি ইউনিয়ন নিয়ে প্রকল্পের নির্মাণকাজ শেষ হয়। নির্মাণকালে প্রকল্পে কৃষি ও অকৃষি জমির পরিমাণ ছিল ১৭ হাজার ৫৮৪ হেক্টর। তার মধ্যে ১৩ হাজার ৬০২ হেক্টর কৃষিজমিতে সেচ সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্য ছিল। চলতি বছর সেচ সুবিধা দেওয়া হয় মাত্র ৪ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে। এখনও সেচ সুবিধাবঞ্চিত রয়েছে মোট জমির অর্ধেক। প্রকল্প এলাকায় প্রায় সাড়ে ৫০০ হেক্টর সেচ সুবিধাবঞ্চিত জমিতে কৃষকরা ৮০টি গভীর নলকূপ দিয়ে চাষাবাদ করছেন।
সূত্রটি আরও জানায়, প্রকল্প নির্মাণের সময় ১৭ হাজার ৫৮৪ হেক্টর কৃষিজমি থাকলেও গত এক যুগে ব্যাপকহারে আবাদি জমিতে ঘরবাড়ি নির্মাণ করায় কৃষিজমির পরিমাণ কমে গেছে অনেক। ২০১৩ সালে কৃষিজমির পরিমাণ এসে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৮৮০ হেক্টরে। এ বছর সেচ সুবিধা দেওয়া হয় মাত্র ৪ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে। বাকি অন্তত ৮ হাজার ৮০০ হেক্টর কৃষিজমির অর্ধেকের বেশি বিনষ্ট হয়েছে ঘরবাড়ি ও হাটবাজার নির্মাণে।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, প্রকল্পে ২০১০ সালে আবাদ করা ধানি জমিতে উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ ছিল ৭২ হাজার টন। ২০১২ সালে আবাদ করা জমিতে ফসল উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৫৬ হাজার টন এবং ২০১৩ সালে উৎপাদন কমে দাঁড়ায় ৪৮ হাজার টন। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে উৎপাদন হয় মাত্র ২৭ হাজার ৪০৮ টন। অথচ মতলব উত্তর উপজেলায় খাদ্য উদ্বৃত্ত ১৮ হাজার টন থেকে নেমে এসেছে ১১ হাজার টনে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রকল্পের সিপাইকান্দি, ঠেটালিয়া, গজরা, আবুরকান্দি, মান্দারতলী, ঘনিয়ারপাড়, রাঢ়ীকান্দি, ছৈয়ালকান্দি, বড় ও ছোট হলদিয়া, নাউরী, ওটারচর, নন্দলালপুর, নবুরকান্দিসহ আরও অনেক এলাকায় কৃষিজমিতে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ঘরবাড়ি। কলেজ শিক্ষক কামরুজ্জামান জানান, প্রকল্প উন্নয়নে গবেষণা না থাকায় সেচ ও নিস্কাশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে। এভাবে চলতে থাকলে প্রকল্পটি এক সময় মৌলিক কাঠামো হারাবে।
উপজেলা ভূমি অফিসের দেয়া তথ্যে জানা যায়, সরকারের ‘রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন-১৯৫০’ অনুযায়ী যেকোনো জমি শ্রেণি পরিবর্তন করতে হলে সরকারের (জেলা কালেক্টরের) অনুমতি নেয়া প্রয়োজন। কিন্তু সরকারের এ আইন তোয়াক্কা করছে না প্রকল্পের কেউ।
ছেংগারচর সরকারি ডিগ্রি কলেজের অধ্যাপক কামাল হোসেন বলেন, প্রকল্প এলাকায় জীববৈচিত্র্যের অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। মাটি ও পানির গুণগত মান পরিবর্তনের কারণে এ এলাকার অনেক প্রাণি (মাছ) ও উদ্ভিদ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
বকেয়া সেচ কর : ১৯৯৮-৯৯ সাল থেকে প্রকল্প এলাকায় সেচ কর (সার্ভিস চার্জ) ধার্য করা হলেও আদায় হয়েছে হাস্যকর পরিমাণ। বার্ষিক সেচ কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ৩৫ লাখ টাকা থেকে নেমে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৮ লাখ টাকায় আনা হয়েছে। সেচ কর আদায়ের সঠিক কোনো পদ্ধতি না থাকার কারণে মাঠ পর্যায়ে বিনা রশিদে সেচ কর আদায় হলেও তার মোটা অঙ্কের টাকা প্রতি বছরই আত্মসাৎ হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। গত ৩০ বছরে সেচ কর বকেয়া পড়েছে প্রায় ৮ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। সেচ কর বকেয়ার কারণে প্রতি বছর প্রকল্প রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিশাল অঙ্কের টাকা গচ্ছা দিতে হয় সরকারকে।
মতলব ও কালিপুর অফিসে দুইজন সাব-ডিভিশনাল প্রকৌশলী থাকার নিয়ম থাকলেও এ অফিসগুলোতে একজন পিয়ন ছাড়া কেউ থাকেন না। দীর্ঘদিন ধরেই ভূতুড়ে অবস্থা বিরাজ করছে অফিস দু’টিতে। অপরদিকে জেলা শহর চাঁদপুরে প্রকল্পের ডিভিশনাল অফিস থাকলেও এখানেও দীর্ঘদিন ধরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনুপস্থিতি, দায়িত্বে অবহেলা, অফিসিয়াল কার্যক্রমে অব্যবস্থাপনা দেখা দিয়েছে। প্রকল্পের বড় বড় জলাশয়কে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে ইজারা দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ আছে প্রকল্পের কর্মকতা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে। এ কারণে লিজ ও দখলদারের সঙ্গে শতাধিক সংঘর্ষের ঘটনা এবং দু’টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. সালাউদ্দিন বলেন, অপরিকল্পিত বাড়িঘর নির্মাণ বন্ধ করে সেচ ও নিষ্কাশন খালগুলো উদ্ধার করতে না পারলে প্রকল্প নির্মাণের লক্ষ্য ব্যাহত হবে।
মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার জানান, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে মানুষের আবাসনের চাহিদা বাড়ছে এবং এই কারণে প্রকল্পের কৃষিজমিতে এত অধিকহারে ঘরবাড়ি হচ্ছে। কৃষিজমি রক্ষায় সরকারের নীতিমালা আছে, কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড তো ব্যবস্থা নিতে পারে না।
২৪ ডিসেম্বর, ২০২০।