রহিম বাদশা:
চারিদিকে সবুজ আর সুবজ। ওপরে শুভ্র-নীল আকাশ। দু’চোখ যেদিকেই নজর পড়ে কেবল প্রাণ জুড়ায়। ছায়া সুনিবিড় কোলাহলমুক্ত সুনশান নীরবতায় আচ্ছন্ন এ এক স্বপ্নলোক। মাঝেমাঝে হৃদয় নাচে পাখ-পাখালির সুমধুর সুর-মূর্ছনায়। রাতে শিয়াল-বাদরের ডাক। সারি সারি বৃক্ষের পাশাপাশি সুবিশাল জলাশয়। কৃত্রিম ঝরনার সাথে মিতালী করেছে কৃত্রিম লেক; যেথা স্বচ্ছ পানির দেখা মিলে হররোজ। বিশাল এক জলাশয়ের ওপর নির্মিত অপরূপ সৌন্দর্যমন্ডিত ঝুলন্ত সাঁকো। সাঁকোর পিলার ও ব্যালকনিতে খোঁদাই করা রঙিন কারুকাজ দেখে মুগ্ধ না হওয়ার উপায় নেই।
সামান্য উঁচু পাহারে শ্যামল আঙ্গিনার শোভা বর্ধণ করেছে গরুর গাড়ি, জিরাপ ও হরিণের নান্দনিক প্রতিকৃতি। নিলাভ বিশালাকৃতির সুইমিংপুল প্রশান্তি জোগায় দেহ-মনে। পুকুরপাড়, লেকেরপাড় আর সুইমিংপুল লাগোয়া থাকার ঘরগুলোর নামও প্রাকৃতিকে বৈচিত্র্যে ভরপুর। শাপলা, জবা, শিউলি, মালতি, জুঁই, কৃষ্ণচূড়া, চম্পা, লোটাস, গন্ধরাজ, রোজ, চামেলি প্রভৃতি বাহারি সব ফুলের নামে একেকটি সুদৃশ্য বাড়ি। আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত বাড়িগুলো ‘কটেজ’ নামেই পরিচিত।
বলছিলাম গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর উপজেলার কালামপুর গ্রামে অবস্থিত ‘সোহাগ পল্লী পিকনিক স্পট ও রিসোর্ট’র কথা। প্রায় ১১ একর জমির উপর স্থাপিত এ যেন একখন্ড শান্তির নিবাস। সেখানে অবস্থান মানেই প্রকৃতির মাঝে থাকা, প্রকৃতিতে হারিয়ে যাওয়া, প্রকৃতিতে খাওয়া, পাখির ডাকে ঘুমানো, শিয়াল-মোরগের ডাকে জাগা। প্রকৃতি আর কৃত্রিমে মিশেল এই অপরূপ সৌন্দর্য্যকে যেন দিগ-দিগন্তে পাহারায় রেখেছে সারি সারি গজারী বৃক্ষ। বনের ভেতর বন! এ যেন একালে স্বেচ্ছায় বনবাসের শ্রেষ্ঠ স্থান। এখানেই অধুনা হয়ে গেল চাঁদপুর প্রেসক্লাবের বার্ষিক আনন্দ ভ্রমণ-২০১৮। ১৮ অক্টোবর রাতে চাঁদপুর লঞ্চঘাটে যে আনন্দের সূচনা হয়েছিল।
প্রেসক্লাব সভাপতি ইকবাল হোসেন পাটোয়ারীর একান্ত আগ্রহে ‘ভাওয়াল রাজার দেশ’ খ্যাত গাজীপুরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবারের আনন্দ ভ্রমণ। যদিও গাজীপুরের বর্তমান পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার চাঁদপুর প্রেসক্লাব থেকে বিদায়ের শেষলগ্নে আমরা ক’জন তাকে বলেছিলাম ‘আপা শীঘ্রই আসছি গাজীপুরে। আপনাকে দেখতে, পিকনিক করতে’। প্রেসক্লাব সাধারণ সম্পাদক মির্জা জাকির ভাইয়ের গুরুতর অসুস্থতার কারণে এবার বছরের শুরুতে আনন্দ ভ্রমণ আয়োজনের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এক বছর মেয়াদী বর্তমান কমিটির সময়সীমা শেষ হবে ৩১ ডিসেম্বর। সে সময় জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাব্য পেশাগত ব্যস্ততার বিষয়টি মাথায় রেখেই দুর্গোৎসবের বিজয়া দশমীর ছুটিতে ভ্রমণের সময়সীমাও চূড়ান্ত করেন সভাপতি-সম্পাদকসহ উপ-কমিটির নেতৃবৃন্দ।
চাঁদপুর প্রেসক্লাবের বার্ষিক আনন্দ ভ্রমণ-২০১৮ এর উদযাপন উপ-কমিটির আহ্বায়ক করা হয় কার্যকরী কমিটির সমাজকল্যাণ সম্পাদক মো. ওমর পাটওয়ারীকে। সদস্য সচিব সাবেক সাধারণ সম্পাদক জি এম শাহীন। সদস্য যথাক্রমে সাবেক সভাপতি শহীদ পাটোয়ারী ও শরীফ চৌধুরী, আমি ও ক্রীড়া সম্পাদক ইয়াছিন ইকরাম। পদাধিকার বলে কার্যকরী কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক যথারীতি উপ-কমিটির সদস্য।
উপ-কমিটির প্রথম সভায় আহ্বায়ক ওমর পাটওয়ারী তার ব্যক্তিগত তহবিল থেকে ১ লাখ টাকা অনুদান দেয়ার ঘোষণা দিয়ে অর্থনৈতিক চাপ অনেকটাই হাল্কা করে দেন। প্রেসক্লাব তহবিল থেকে আরো ১ লাখ টাকা দেয়ার ঘোষণা দিলেন সভাপতি ইকবাল হোসেন পাটোয়ারী। অবশ্য শর্ত দিলেন- একান্ত নিজস্ব আঙ্গিকে আয় বাড়িয়ে ও যথাসম্ভব ব্যয় কমিয়ে মানসম্মত আয়োজনে ভ্রমণ করেও এই টাকা যেন ফেরত দেয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়। আমরাও কথা দিলাম, চেষ্টার ত্রুটি হবে না। সিদ্ধান্ত হলো- গাজীপুরের সোহাগ পল্লী, নন্দন পার্ক, বঙ্গবন্ধু সাফারী পার্ক আর আশুলিয়ার ডেফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির স্থায়ী ক্যাম্পাসে হবে আনন্দ ভ্রমণ।
২০১৫ সালের রাঙ্গামাটি ও কাপ্তাইয়ের স্মরণীয় ভ্রমণকে মাথায় রেখে ভ্রমণ সর্বোচ্চ আনন্দদায়ক করতে এবারো আমরা গাজীপুরের পিকনিক স্পটে আগাম পর্যবেক্ষক দল যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। প্রেসক্লাব সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, উপ-কমিটির আহ্বায়ক ও ক’জন সদস্য ব্যক্তিগত ব্যস্ততার কারণে এ দলে থাকতে পারলেন না। শেষ পর্যন্ত উপ-কমিটির সদস্য সচিব জি এম শাহীন ও ইয়াছিন ইকরামের সাথে আমি গেলাম সেই আগাম দলে। ভোর রাতে যাত্রা করে দুপুরে যেয়ে পৌঁছলাম গাজীপুরের কালিয়াকৈর থানার অফিসার ইনচার্জ মো. আলমগীর হোসেনের (চাঁদপুরের কয়েকটি থানার সাবেক ওসি) সরকারি বাসায়। সেখানেই মধ্যহ্নভোজ করিয়ে আমাদের নিয়ে রওয়ানা হলেন ভ্রমণের স্পটগুলোতে। প্রথমেই সোহাগপল্লী। এরপর নন্দন। এই দু’টি স্পট খুব ভালো লাগলো। বিশেষ করে প্রথম দর্শনে সোহাগ পল্লীর প্রাকৃতিক রূপ-বৈচিত্র দেখে আমরা অভিভূত, উদ্বেলিত ও মুগ্ধ হয়েছিলাম। ডেফোডিলের স্থায়ী ক্যাম্পাস আগেই দেখা ছিল, তাই পরিদর্শনের প্রয়োজন অনুভব করলাম না। দূরত্বের কারণে ও সময়ের অভাবে বঙ্গবন্ধু সাফারী পার্ক আর দেখা সম্ভব হয়নি সেদিন। তবে সেই থানার ওসি জাবেদুল ইসলাম মুঠোফোনে আশ্বস্ত করে বললেন, ‘আপনারা না আসলেও চলবে। কোনো সমস্যা হবে না। ঠিক তারিখে চলে আসবেন।’ এবার আমাদের ফেরার পালা। রাত তখন সাড়ে ১২টা। ওসি আলমগীর অনুরোধ করলেন রাতটা থেকে যেতে। কিন্তু আমরা আরো কিছু সময় তার বাসায় গল্প করে রাত দেড়টায় গাজীপুর থেকে রওয়ানা হলাম। ভোর সাড়ে ৫টায় চাঁদপুর শহরে প্রত্যাবর্তন করলাম আমরা।
১৮ অক্টোবর রাত সোয়া ১২টায় চাঁদপুর লঞ্চঘাট থেকে ময়ূর লঞ্চযোগে প্রেসক্লাবের বিভিন্ন পর্যায়ের ৩৩জন সদস্য ও তাদের পরিবার মিলিয়ে মোট ১১০জন সদস্য নিয়ে শুরু হয় আনন্দযাত্রা। লঞ্চ ছাড়ার কিছু সময়ের মধ্যে আমাদের পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতিজন সদস্যের জন্য পৃথক প্যাকেটে রাত ও সকালের নাস্তা-পানি পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করি। সাথে দেয়া হয় এক পৃষ্ঠার একটি ভ্রমণসূচি। এতে দুই দিন, তিন রাত ভ্রমণের পূর্ণাঙ্গ বিস্তারিত সময়সূচি, যাওয়া ও আসার লঞ্চের কেবিন নম্বর, সোহাগ পল্লীর কটেজের কক্ষের নাম এবং বাসের নম্বরও উল্লেখ করা হয়। তবে বাসের সিট নম্বর দেয়া হয়নি। তিন বাসের তিনজন সমন্বয়কারীকে (সাবেক সভাপতি শহীদ পাটোয়ারী ও বি এম হান্নান, সাবেক সাধারণ সম্পাদক গিয়াসউদ্দিন মিলন) বলে দেয়া হয়েছিল প্রতিটি বাসের সামনের আসনগুলোতে নারী ও শিশুরা বসবেন, পুরুষ সদস্যরা পেছনে বসবেন। চাঁদপুর টেলিভিশন সাংবাদিক ফোরামের বিগত ভারত সফরে বাসের আসন বিন্যাসের এই প্রশংসিত পদ্ধতি এখানেও প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমরা। প্রেসক্লাব সভাপতি ইকবাল হোসেন পাটোয়ারী ও সাধারণ সম্পাদক মির্জা জাকিরের পরামর্শ নিয়ে আমি ও জি এম শাহীন ভ্রমণসূচির কঠিন এই কাজটি সম্পন্ন করি। কম্পিউটার জানার অপরাধে কম্পোজ, ডিজাইন, প্রিন্টও করতে হয়েছে আমাকে! নাস্তা আর অনুষ্ঠানসূচি দেয়ার পর সবাই যে যার মতো করে ঘুমিয়ে পড়ি। লঞ্চের ৩১টি এসি কেবিনের যোগান দিয়ে কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ করেন লঞ্চটির সুপারভাইজার আলী আজগর সরকার।
ভোর সাড়ে ৪টায় আমরা পৌঁছে যাই সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে। সবাই ঘুম থেকে জাগতে অনেকটা সময় লেগে যায়। লঞ্চ থেকে নেমে ৬টার মধ্যে ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে আমরা সবাই হাজির। সেখানে অপেক্ষা করছিল ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির তিনটি বাস। এখানে কিছু সময় অপেক্ষা করতে হলে প্রকাশনা সম্পাদক মাহবুবুর রহমান সুমনের পরিবারের সদস্যদের জন্য। তাদের যাত্রাবাড়ি থেকে আসতে কিছুটা বিলম্ব হয়েছিল। সকাল সাড়ে ৬টার দিকে আমরা সবাই রওয়ানা করি গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার সোহাগ পল্লীর উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যে টঙ্গীতে আমাদের সাথে যুক্ত হন অ্যাড. শাহজাহানের পরিবার। আমাদের বহনকারী বাসগুলো উন্নত ও আরামদায়ক ছিল। একমাত্র এসি ছাড়া আরো কোনো অপূর্ণতা নেই বাসগুলোতে। মাত্র দু’ঘণ্টার বাসভ্রমণ করেই আমরা পৌঁছে যাই সোহাগ পল্লীতে। ¯িœগ্ধ সকালে প্রকৃতি আর কৃত্রিমে সাজানো সোহাগপল্লীর সৌন্দর্য্য দেখে ভ্রমণে অংশগ্রহণকারী সবার মুখে আনন্দের ছাপ ছিল স্পষ্ট। কেউ কেউ দারুণভাবে উচ্ছ্বসিত-উদ্বেলিত হয়েছিল।
সোহাগ পল্লীর প্রধান ফটক থেকে আবাসিক কক্ষে (কটেজ) যেতে যেতে নব নব সৌন্দর্য্যে বিস্মিত হতে দেখেছি অনেককে। আমার স্ত্রী, সন্তানও দেখলাম বেশ আনন্দিত এমন পিকনিক স্পট ও কটেজ পেয়ে। অনুষ্ঠানসূচি অনুযায়ী এবার ফ্রি টাইম। যে যার মত সময় কাটাবে। অনেকেই পুরো এলাকা ঘুরে বেড়িয়েছে। শিশু ও নারীদের অনেকে বিশাল সুইমিংপুলে জলকেলির আনন্দে অবগাহন করেছে। আমি অবশ্য সময়টা কাটাই ঘুমিয়ে। বেলা সাড়ে ১২টায় মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেই সবাই। সোহাগপল্লীর ভেতরে বিশাল পুকুরের পাড়ে ‘মেজবান’ নামের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রেস্টুরেন্টটিও ছিল দেখার মতো। শতাধিক মানুষের কেউ’ই খাবারের আইটেম বা মান নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। যা এর আগের কোনো ভ্রমণেই দেখা যায়নি। বলে রাখা ভালো, এসব খাবারের আইটেম অগ্রবর্তী টিমের পরিদর্শনকালেই আমরা ঠিক করে রেখেছিলাম। সবার তৃপ্তিতে আয়োজক কমিটির সাথে সম্পৃক্ত আমরা সবাই তৃপ্ত হলাম।
দুপুরের খাবারের ফাঁকে অনেকেই সোগাপল্লীর এক কোণে অবস্থিত মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করে নিলাম। বেলা আড়াইটায় আবারো সবাই চাপে উঠে বসলাম। এবারের গন্তব্য গাজীপুরের আরেক আকর্ষণীয় পিকনিক স্পট ও থিম পার্ক ‘নন্দন’। (চলবে)