মানবসেবায় রোটারী ফাউন্ডেশন

রোটা. মাহবুবুর রহমান সুমন এমপিএইচএফ

মানবসেবায় রোটারী ফাউন্ডেশন পৃথিবীর নানা প্রান্তে বিভিন্ন সেবামূলক কাজ করছে। এর মধ্যে পোলিও নির্মূল, শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং সামাজিক উন্নয়ন অন্তর্ভূক্ত। এছাড়া দারিদ্র্যমুক্তি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, মা ও শিশুস্বাস্থ্য, নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন ইত্যাদি বিষয়ে বিশ্বের নানা প্রান্তে রোটারী ফাউন্ডেশন নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে। বিশেষ করে ধর্মীয় মূল্যবোধের কারণে যারা বিভিন্ন দান-সদকা দিয়ে থাকেন, রোটারী ফাউন্ডেশন প্রায় ঐসব কাজেই তাদের প্রকল্পে তা’ ব্যয় করে থাকে।
রোটারী ফাউন্ডেশনের উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম হচ্ছে বিশ্ব থেকে পোলিও নির্মূল। ১৯৮৪ সালে পোলিও প্লাসের কার্যক্রম শুরু করে রোটারী ইন্টারন্যাশনাল। ধীরে ধীরে পৃথিবী থেকে পোলিও নির্মূলের পথে এগিয়ে গেলে ২০১১ সালে এগিয়ে আসেন বিশ্বের শীর্ষ ধনী বিল গেটস। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিল এন্ড মেলিন্ড গেটস পোলিও নির্মূলে রোটারী ফাউন্ডেশনকে ১শ’ বিলিয়ন ডলার দান করেন। চলতি রোটারী বর্ষে পোলিও নির্মূলে মহাপরিকল্পনা করেছে রোটারী। সারা পৃথিবী পোলিও মুক্তকরণে রোটারী ইন্টারন্যাশনাল প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে।
এছাড়া আফ্রিকার বিভিন্ন দেশসহ তৃতীয় বিশ্বের অভাবগ্রস্ত দেশে বিভিন্ন প্রকল্প তৈরি করে রোটারী ফাউন্ডেশনের ফান্ড থেকে মানুষের সেবা করা হচ্ছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানেও বৃহৎ প্রকল্পগুলোতে রোটারী ফাউন্ডেশন সহযোগিতা করে আসছে।
রোটারী ফাউন্ডেশনের ফান্ড তৈরি হয় মূলতঃ রোটারী ক্লাবের সদস্য অর্থাৎ রোটারিয়ানদের মাধ্যমে। রোটারিয়ানরা রোটারী ফাউন্ডেশনে প্রতি বছরই তাদের অনুদান জমা দিয়ে ঐ ফান্ডকে করেছে সমৃদ্ধ। যা’ বেসরকারি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের অন্যতম বৃহৎ ফান্ড হিসেবে স্বীকৃত। ১৯০৫ সালে রোটারী ক্লাবের জন্ম হলেও প্রায় ১২ বছর পরে এই ফান্ড শুরু হয়।
১৯১৭ সালে রোটারীর প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম সদস্য ও তৎকালীন রোটারী ইন্টারন্যাশনালের প্রেসিডেন্ট রোটারিয়ান আর্ক সি. ক্লাম্প বর্তমানে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ আর্থিক ফান্ড ‘রোটারী ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯১৭ সালের রোটারী কনভেনশনে তিনি আর্তমানবতার সেবায় একটি ফান্ড গঠনের প্রস্তাব দিলে ‘রোটারী ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠা করা হয়।
এরপর থেকে গত শতবর্ষে সারা পৃথিবীর রোটারিয়ানদের অনুদানে রোটারী ফাউন্ডেশন বিশ্বের দরিদ্র ও অসহায় মানুষের সেবা করে আসছে। বিশ্বের বিভিন্ন অসহায় মানুষ ও দরিদ্রপীড়িত দেশে রোটারীর এই ফান্ড থেকে বিভিন্ন প্রকল্প তৈরি করে সেবা প্রদান করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, খাদ্য ও বাসস্থানসহ নানা প্রকল্পে অসহায় মানুষদের সহযোগিতা করছে। এছাড়া দরিদ্রদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, শিশু ও মাতৃ স্বাস্থ্য এবং বিভিন্ন অঞ্চলের শান্তি প্রতিষ্ঠায় রোটারী ফাউন্ডেশন কাজ করে থাকে।
বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই ফান্ডও সমৃদ্ধ করেন রোটারিয়ানরা। তবে নন-রোটারিয়ান অর্থাৎ সাধারণ বিত্তশালীরাও এই ফান্ডে দান করতে পারেন, তবে তা’ সীমিত অবস্থায়। এই ফাউন্ডেশনে বিভিন্ন পর্যায়ে দানকারীদের বিভিন্নভাবে পদক দেয় রোটারী ইন্টারন্যাশনাল। মাত্র ১শ’ ডলার অনুদান প্রদান করলে আরএফএসএম (রোটারী ফাউন্ডেশন সাসটেইনিং মেম্বার), ১ হাজার ডলার এই ফান্ডে অনুদান প্রদান করলে পিএইচএফ (পল হ্যারিস ফেলো) পদক দেয়া হয়। এছাড়া ২ হাজার থেকে ৯ হাজার ৯শ’ ৯৯ ডলার পর্যন্ত এমপিএইচএফ (মাল্টিপল পল হ্যারিস ফেলো), ১০ হাজার থেকে ২ লাখ ৪৯ হাজার ৯শ’ ৯৯ ডলার পর্যন্ত এমডি (মেজর ডোনার) এবং ২ লাখ ৫০ হাজার থেকে ১ কোটি ডলার (১০ মিলিয়ন) একেএস (আর্ক ক্লাম্প সোটাইটি মেম্বার) পদক দেয়া হয়।
এছাড়া রয়েছে পিএইচএস (পল হ্যারিস সোসাইটি মেম্বার) পদক, যারা আজীবন প্রতি বছর কমপক্ষে ১ হাজার ডলার করে ফাউন্ডেশনে অনুদান প্রদান করেন। এছাড়া রয়েছে বেনিফ্যাক্টর পদক, যা’ ১ হাজার ডলার থেকে ১ কোটি ডলার পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপ রয়েছে। নন-রোটারিয়ান অর্থাৎ সাধারণ মানুষ এই ফান্ডে ১ হাজার ডলার দান করে পেতে পারেন পিএইচএফ (পল হ্যারিস ফেলো) পদক।
রোটারী জেলা-৩২৮২ (বাংলাদেশ) এর ১৩৪টি ক্লাবের প্রায় ৩ হাজার রোটারিয়ানদের মধ্যে ৭৫২ জন পিএইচএফ ও এমপিএইচএফ পদকপ্রাপ্ত রয়েছেন। এছাড়া রয়েছেন সহস্রাধিক আরএফএসএম পদকধারী রোটারিয়ান। এছাড়া রয়েছেন এমডি (মেজর ডোনার), একেএস (আর্ক ক্লাম্প সোটাইটি মেম্বার), পিএইচএস (পল হ্যারিস সোসাইটি মেম্বার) এবং বেনিফ্যাক্টর।
পৃথিবীর নানা দেশে শতভাগ আরএফএসএম, পিএইচএফ ও পিএইচএস ক্লাবও রয়েছে। ঐসব ক্লাবের সব সদস্য’ই রোটারী ফাউন্ডেশনে যথাক্রমে ১শ’ ও ১ হাজার ডলার বা প্রতিবছর ১ হাজার ডলার করে অনুদান প্রদান করেন।

চাঁদপুরের রোটারিয়ানদের ফাউন্ডেশনে অবদান

চাঁদপুর জেলায় ৪টি রোটারী ক্লাব থেকে এ পর্যন্ত (২০১৮ সালের ৩০ জুন) ৪১,৭৫৪.৭৪ ডলার (৩৫ লাখ ৪৯ হাজার ১শ’ ৫২. ৯০ টাকা) রোটারী ফাউন্ডেশনে অনুদান প্রদান করা হয়েছে। এর মধ্যে চাঁদপুর রোটারী ক্লাব ২২,০১৩.০৩ ডলার, চাঁদপুর সেন্ট্রাল রোটারী ক্লাব ১৩,১৪১.৬৯ ডলার এবং হাজীগঞ্জ রোটারী ক্লাব ৬,৬০০ ডলার প্রদান করে। নতুন ক্লাব হিসেবে মতলব রোটারী ক্লাবের সদস্যরা এখনো পর্যন্ত কোন অনুদান প্রদান করেনি। চাঁদপুরের ৪টি রোটারী ক্লাবের মধ্যে ১ জন এমপিএইচএফ এবং ৩৭ জন পিএইচএফ পদকধারী রয়েছেন।
চাঁদপুর রোটারী ক্লাবের প্রাক্তন সভাপতি রোটারিয়ান এমএ মাসুদ ভূঁইয়া ও রোটারিয়ান সুবির পোদ্দার ১৯৭৫ সালের ১ জানুয়ারি ১ হাজার ডলার অনুদান প্রদান করে প্রথম পিএইচএফ পদক লাভ করেন। পরবর্তীতে অনেকেই পিএইচএফসহ অন্যান্য পদক লাভ করেন। গত ২০১৭ সালে ২ হাজার ডলার প্রদান করে এমপিএইচএফ পদক লাভ করেন লেখক রোটারিয়ান মাহবুবুর রহমান সুমন। চাঁদপুর জেলার ৪টি ক্লাবের মধ্যে প্রথম ও একমাত্র এমপিএইচএফ পদকধারী রোটারিয়ান মাহবুবুর রহমান সুমন। তবে আরো কয়েকজন রোটারিয়ান ১ সহস্রাধিক ডলার প্রদান করেছেন, তারাও দ্রুত ২ হাজার ডলার পূর্ণ করে এমপিএইচএফ পদক লাভ করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালে তৎকালীন জেলা গভর্নর নমিনি রোটারিয়ান সুফী মো. মিজানুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী একেএস পদকের জন্য ৫ লাখ ডলার (জনপ্রতি ২ লাখ ৫০ হাজার ডলার) অনুদান প্রদান করেন। একেএস পদকধারী সুপারিশে বিশেষভাবে বাংলাদেশের দুই শতাধিক রোটারিয়ান ৩শ’ ও ৫শ’ ডলার অনুদান প্রদান করে পিএইচএফ পদক লাভ করেন।
চাঁদপুর রোটারী ক্লাবের পিএইচএফ পদকধারীরা হচ্ছেন : রোটারিয়ান এম এ মাসুদ ভূঁইয়া, রোটারিয়ান সুবির পোদ্দার, মরহুম রোটারিয়ান ডা. নূরুর রহমান, রোটারিয়ান সুভাষ চন্দ্র রায়, রোটারিয়ান জয়নাল আবেদীন, রোটারিয়ান ডা. এমএম শহিদ উল্লাহ, রোটারিয়ান কাজী শাহাদাত, রোটারিয়ান এবিএম নজরুল ইসলাম চৌধুরী, রোটারিয়ান অ্যাড. ইকবাল-বিন-বাশার, রোটারিয়ান মোশারফ হোসেন মানিক চৌধুরী, রোটারিয়ান মোবারক হোসেন চৌধুরী, রোটারিয়ান অ্যাড. শরীফ মো. ফেরদৌস শাহীন, রোটারিয়ান হাজি আবুল কাশেম গাজী, রোটারিয়ান নাসির উদ্দিন খান, রোটারিয়ান অ্যাড. বিনয় ভূষণ মজুমদার, রোটারিয়ান ডা. স্বপন কুমার মজুমদার (ডা. এসকে মজুমদার), রোটারিয়ান এ. হাফিজ মিয়া, রোটারিয়ান তোফায়েল আহমেদ শেখ, রোটারিয়ান অ্যাড. সাইয়েদুল ইসলাম বাবু, রোটারিয়ান অ্যাড. নজরুল ইসলাম খোকন, রোটারিয়ান ডা. এমএ গফুর, রোটারিয়ান মাহবুবুর রহমান সুমন ও রোটারিয়ান মো. মোস্তফা (ফুল মিয়া)।
চাঁদপুর সেন্ট্রাল রোটারী ক্লাবের পিএইচএফ পদকধারীরা হচ্ছেন : রোটারিয়ান শেখ হাবিবুর রহমান, রোটারিয়ান ফনী ভূষন চন্দ, রোটারিয়ান মো. জাহাঙ্গীর আলম, রোটারিয়ান আলহাজ এসএম সফিকুল ইসলাম, রোটারিয়ান বিশ্বরঞ্জন সেন, রোটারিয়ান মো. দেলোয়ার হোসেন (বর্তমানে মতলব রোটারী ক্লাবের সদস্য), রোটারিয়ান বাবুলাল কর্মকার, রোটারিয়ান মো. মিজানুর রহমান খান, রোটারিয়ান মো. আলমগীর পাটওয়ারী ও রোটারিয়ান ডা. বিশ্বনাথ পোদ্দার।
হাজীগঞ্জ রোটারী ক্লাবের পিএইচএফ পদকধারীরা হচ্ছেন : রোটারিয়ান হারুনুর রশিদ মুন্সী, রোটারিয়ান মো. আলী আশ্রাফ দুলাল, রোটারিয়ান মো. আব্দুল হান্নান, রোটারিয়ান বিএম আহসান কলিম, রোটারিয়ান নূরুর রহমান কাজী, রোটারিয়ান মো. আমির হোসেন পাটওয়ারী, রোটারিয়ান এম. মশিউর রহমান পাটওয়ারী, রোটারিয়ান গৌতম সাহা ও রোটারিয়ান মিয়া মো. সেলিম।
উল্লেখ্য, রোটারী ইন্টারন্যাশনাল ব্যবসায়িক ও পেশাদার ব্যক্তিদের নিয়ে গড়ে উঠা বিশ্বব্যাপী সেবামূলক সংগঠন। উচ্চস্তরের মানদ-, সমাজসেবা ও আন্তর্জাতিক বোঝাপড়ায় এ সংগঠনের ভূমিকা অপরিসীম। প্রত্যেক ব্যবসায়িক ও পেশাদার ক্লাব থেকে যোগ্য ব্যক্তিরাই রোটারী ক্লাবের সদস্য হয়ে থাকেন।
শিকাগোর মার্কিন অ্যাটর্নি পল পি. হ্যারিস ১৯০৫ সালে এ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন যা বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানরূপে স্বীকৃত। প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি, ব্যবসায় ও পেশাদারী পর্যায়ে উচ্চ নৈতিক মূল্যবোধ গঠন এবং বিশ্বব্যাপী ফেলোশীপ প্রদানের মহান ব্রত নিয়ে আদর্শ সেবা প্রদানকল্পে এ সংগঠনটি গঠন করেন। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়েই এ সংগঠনের সদস্যপদের জন্য সীমারেখা নির্দিষ্ট করে যান। একবিংশ শতকের শুরুতে বিশ্বের দুই শতাধিক দেশ ও ভৌগোলিক এলাকায় ১.২২ মিলিয়নেরও বেশি সদস্য রয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়িস অঙ্গরাজ্যের এভানস্টোনে রোটারী ইন্টারন্যাশনালের সদর দফতর অবস্থিত। ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে সদস্যদের কার্যালয়ে সভা অনুষ্ঠিত হওয়ায় এর নাম রোটারী রাখা হয়েছে। শুরুতে এটি ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব রোটারী ক্লাবস নামে পরিচিত ছিল। ১৯২২ সালে এর নামকরণ করা হয় রোটারী ইন্টারন্যাশনাল। বিশ্বের অন্যান্য দেশে এ সংগঠনটি রোটারী ক্লাব নামে পরিচিত। বিভিন্ন জনকল্যাণমুখী সেবামূলক প্রকল্প গ্রহণের পাশাপাশি ১৯১৭ সালে রোটারী ফাউন্ডেশন গঠন করা হয়। ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে বিদেশে পড়াশোনার জন্য বৃত্তি, মানবধর্মী প্রকল্পে অর্থবরাদ্দ এবং নন-রোটারিয়ানদের বিদেশ সফরের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রশিক্ষণে নিয়ে যাওয়া হয়।
(তথ্যসূত্র: রোটারী ফাউন্ডেশনের সেমিনার সুভ্যেনির ও রোটারী ইন্টারন্যাশনাল অফিস)
রোটা. মাহবুবুর রহমান সুমন এমপিএইচএফ: ডিরেক্টর (ক্লাব সার্ভিস), চাঁদপুর রোটারী ক্লাব।