চাঁদপুর সদর হাসপাতালে শয্যার দ্বিগুণ রোগী ভর্তি

স্টাফ রিপোর্টার
চাঁদপুর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের করিডোর-বারান্দায় চাদর ও পাটি বিছিয়ে সেবা নিচ্ছেন রোগীরা। গাদাগাদি করে রোগী ও স্বজনরা বসে আছে। রোগীদের বিছানার পাশ দিয়ে মানুষজন হেঁটে যাচ্ছে। এতে রোগ-জীবাণু ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে। হাসপাতালের আউটডোর ও ইনডোরেও চিকিৎসা নিচ্ছে রেকর্ডসংখ্যক রোগী। এ অবস্থায় রোগীদের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক ও নার্সরা।
চলমান প্রচণ্ড তাপদাহে অসুস্থ হয়ে এ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন রেকর্ডসংখ্যক রোগী। গত কয়েকদিনের প্রচণ্ড গরমে অসুস্থ হয়ে পড়ছে শিশু ও বয়স্করা। এর মধ্যে শিশু রোগীর সংখ্যাই বেশি। রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে চিকিৎসক ও নার্সদের।
সরজমিনে ঘুরে এমন চিত্র পাওয়া যায়। গত সোমবার ৫০১ রোগী হাসপাতালে ভর্তি ছিল। অথচ পুরো হাসপাতালে ২৫০টি শয্যা রয়েছে। বাকি ২৫১ রোগী ওয়ার্ডের মেঝে ও বারান্দায় বিছানা করে সেবা নিচ্ছে। সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি ছিল হাসপাতালের পুরুষ, শিশু ও নারী ওয়ার্ডে। পুরুষ ওয়ার্ডে ভর্তি ছিলো ১২৩ জন, নারী ওয়ার্ডে ভর্তি আছে ১৩৭ জন, শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি আছে ১০৩ জন, গাইনি ও প্রসূতি ওয়ার্ডে ভর্তি আছে ৩৮ জন, সিসিইউতে ভর্তি আছে ১৯ জন, আইসিসিইউতে ভর্তি আছে ৪ জন, এসসিএএনইউ এবং কেএমসি ওয়ার্ডে ভর্তি আছে ১০ জন, কেবিনে ভর্তি আছে ২৪ জন, ওয়ান স্টপ ইমারজেন্সি কেয়ারে ভর্তি আছে ৭ জন।
এছাড়া আউটডোরে টিকিট কাউন্টারের সামনে নারী-পুরুষের ভিড় দেখা গেছে। গত ২৩ সেপ্টেম্বর সারা দিন ১,৩৩৪ রোগী আউটডোর সেবা নেয়। এর মধ্যে ৩৮৯ জন পুরুষ রোগী, ৩৫৯ জন নারী রোগী ও ৪৯৬ জন শিশু রোগী সেবা নেয়।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, সোমবার হাসপাতালের বহির্বিভাগে প্রায় ৩০০ রোগী সেবা নিয়েছে। এদের মধ্যে ভর্তি হয়েছেন ২২০ জন, আবার অনেকে চিকিৎসা সেবা নিয়ে বাড়ি চলে গেছে।
ফরিদগঞ্জ উপজেলার সালমা বেগম (৩২) বুকে ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। কোথাও জায়গা পাননি। তিনি বারান্দায় কাছের একটি ছোট্ট স্থানে ফোম দিয়ে বিছানা পেতে স্বজনকে নিয়ে রয়েছেন। তিনি বলেন, হায়রে গরম, ওপরে ফ্যান নাই, অবস্থা আরো খারাপ। কোথাও সিট খালি নাই। চলাচলের রাস্তার দুই পাশে রোগীরা বিছানা বিছিয়ে শুয়ে বসে আছেন। পা ফেলার জায়গা নেই। এমন একটা পরিস্থিতি আমরা চিকিৎসা নিতে এসে যেন বিপাকে পড়ে গেছি।
সদর উপজেলার তরপুরচন্ডী ইউনিয়নের বাসিন্দা মাসুম বিল্লাহ। এক বছরের শিশুকে নিয়ে হাসপাতালে আছেন গত ৪ দিন ধরে। তিনি জানান, গরমজনিত কারণে মেয়ের ঠান্ডা ও নিউমোনিয়ার চিকিৎসা চলছে। তবে শিশু ওয়ার্ডে অনেক রোগী, যার কারণে সেখানে বেড না পেয়ে বারান্দায় থাকতে হচ্ছে।
সদর উপজেলার মৈশাদী ইউনিয়নে তাসলিমা আক্তার জানান, সম্প্রতি তার সিজারে বাচ্চা হয়েছে। প্রথমে কোনো সিট না পেলেও পরে অনেক কষ্টে একটা সিট পেয়েছেন। সিট পেলেও ওয়ার্ডে সবসময় মানুষের ভিড়। বিছানা ঘেঁষে মানুষজন চলাফেরা করছে। আবার যে বেডগুলো দেয়া হয়, তা খুবই অপরিষ্কার। এছাড়া টয়লেটের অবস্থা খুবই খারাপ। এটি কোনোভাবেই ব্যবহার উপযোগী নয়।
শিশু ওয়ার্ডে ঘুরে একাধিক শিশুর অভিভাবকের সঙ্গে কথা হয়। তারা বলেন, জ্বর, পাতলা পায়খানা ও বমি হওয়ার কারণে হাসপাতালে এসে শিশুদের চিকিৎসা নিচ্ছেন। রোগী বেশি হওয়ায় কাঙ্ক্ষিত সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া প্রয়োজনীয় অনেক ওষুধ বাইরে থেকে কিনে আনতে হয়।
রোগীদের অভিযোগ, সদর হাসপাতালে রোগী ভর্তি করানো হলে যেসব পরীক্ষা দেয়া হয়, তা নিয়ে দালালরা টানাটানি করে। কিছুসংখ্যক দালাল রোগী ভর্তি হওয়ার পর ডাক্তারের রুমের সামনেই দাঁড়িয়ে থাকে। তারা প্রেসক্রিপশন রোগীর হাত থেকে নিয়ে বাইরে অন্য ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা করানোর জন্য টানাটানি করে।
হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার (আরএস) ডা. মাহমুদুন্নবী মাসুম বলেন, চাঁদপুর সদর হাসপাতালে ২৩ সেপ্টেম্বর ২৫০ শয্যা বেডে ৫০১ জন ভর্তি ছিলো। নিয়মিত ৪৫০ থেকে ৫০০ রোগী ভর্তি থাকে। আমাদের সার্জারী ওয়ার্ডে ৪০টি বেডে ১২০ জন রোগী ভর্তি রয়েছে। আমরা চিকিৎসকরা চেষ্টা করছি চাঁদপুরের মানুষদের ভালো সেবা দেওয়ার জন্য। আপনাদের সবার সহযোগিতায় চাঁদপুরের মানুষকে ভালো সেবা দিয়ে সেবার মান বাড়াতে চেষ্টা করবো।
তিনি আরো বলেন, এ গরমে প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের না যাওয়াই ভালো। সবাই ছায়াযুক্ত স্থানে থাকবেন এবং বেশি বেশি পানি পান করবেন। বিশেষ করে অভিভাবকদের শিশুদের প্রতি আলাদা নজরদারি ও যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন।
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. একেএম মাহবুবুর রহমান বলেন, চাঁদপুর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ৮টি উপজেলার প্রায় ২৮ লাখ জনগণের একমাত্র হাসপাতাল। সে কারণে রোগীর চাপ অনেক বেশি। ২৫০ শয্যার হাসপাতালে প্রতিনিয়ত প্রায় ৪০০ থেকে ৪৫০ রোগী ভর্তি থাকে। যদিও আমাদের জনবল যা থাকার কথা তারচেয়ে অনেক কম জনবল নিয়ে আমরা কাজ করছি। ৬৭টি চিকিৎসকের পদে ৪৮ পদে চিকিৎসক আছেন। ১৯টি পদে চিকিৎসক নেই। নার্সিংয়ে ৪০টি পদ খালি রয়েছে। এছাড়া বেশ কিছু নতুন ইউনিট স্থাপন করা হয়েছে। যেমন ওয়ান স্টপ কেয়ার, আইসিউ, স্কেনো চালু করা হয়েছে। কিন্তু এ সেবাগুলোর জন্য কোন নতুন জনবল প্রদান করা হয়নি।
তিনি আরো বলেন, গত ২৩ সেপ্টেম্বর চাঁদপুর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যার ছিলো ৫০১ জন। এর আগে ২৪ ঘণ্টায় ২২০ জন রোগী ভর্তি হয়েছে। ২৫০ শয্যার বিপরীতে আমরা ৫০১ জনকে সেবা দিচ্ছি। আমাদের ডাক্তার, নার্স ও চিকিৎসকরা অনেক কষ্ট করে এ রোগীদের সেবা দিচ্ছেন। এজন্য আমার ডাক্তার ও নার্সসহ চিকিৎসা সহকারীদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
তিনি বলেন, অত্যাধিক রোগীর চাপে আমরা সবাইকে বেড দিতে পারছি না। হয়তোবা রোগীদের যতটুকু সময় দেওয়ার ততটুকু সময় দিতে পারছি না। আর একজন রোগীর সাথে ৪/৫ জন করে লোক থাকে, তার ফলে অনেক লোক হয়ে যায়।

২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪।