পৃথিবীর কুৎসিততম দুর্ভাগা একজন নারী

ইল্শেপাড় ডেস্ক
পৃথিবীর কুৎসিততম এক নারী। সারা শরীরে বড় বড় লোম, অস্বাভাবিক বড় চোখ, কান আর নাক, পুরু ঠোঁট। মুখের ভিতর অসংখ্য দাঁত মাড়ি ঠেলে উঠেছে। উচ্চতা মাত্র চার ফুট পাঁচ ইঞ্চি। মার্কিন চিকিৎসকরা পরীক্ষা করে রায় দিয়েছিলেন, সে মানুষই নয়, মানুষ আর ওরাং ওটানের মিশ্রণ। নাম জুলিয়া পাস্ত্রানা, জন্ম মেক্সিকোর সিনালোয়া অঞ্চলে, ১৮৩৪ সালে।
জন্মের পর পরিবার তাকে ত্যাগ করেছিল, সম্ভবত বিক্রি করে দেয়া হয়েছিল। দাসী হিসেবে সিনালোয়ার গভর্নরের বাড়িতে কাজ জোটে এই কুৎসিত মেয়েটির। ধারণা করা হয়, গভর্নরের ভোজসভায় তাকে দেখিয়ে অভ্যাগতদের বিনোদন দেয়া হতো। একটু বড় হলে এক কাস্টমস অফিসার জুলিয়াকে কিনে নেন ও তাকে আমেরিকা নিয়ে যান। আমেরিকায় তখন সার্কাস বা ফ্রীক শো’র নামে মানব প্রদর্শনীর রমরমা ব্যবসা চলছিল। হাত বদল হয়ে হয়ে জুলিয়া বিভিন্ন ভাবে জন্তুর মতো প্রদর্শিত হতে থাকে এই সব শো-তে ।
১৮৫৪ সালে বিধাতা সম্ভবত মুখ তুলে চাইলেন এই কুৎসিত নারীটির প্রতি। থিওডোর লেন্ট নামের এক ব্যক্তিকে ভালবেসে ফেললেন জুলিয়া, থিওডোরও বাসলেন। পশুর মতো বন্দী জীবন শেষ হলো জুলিয়ার। থিওডোরের হাত ধরে তিনি পালিয়ে গেলেন বাল্টিমোরে, এবং সেখানেই তাদের বিয়ে হলো।
কিন্তু বিধি বাম। জুলিয়াকে হাতের মুঠোয় পাওয়া মাত্র স্বরূপে আবির্ভূত হলেন তার প্রেমিক স্বামী ও তিনিও আমেরিকা জুড়ে বিভিন্ন প্রদর্শনীর আয়োজন করে জুলিয়াকে দেখিয়ে অর্থ উপার্জন করতে লাগলেন। জুলিয়ার স্বামী এইসব শো’র বিজ্ঞাপনে নিজের স্ত্রীকে ‘মানুষ আর ওরাং ওটান-এর মিশ্রণ’ বলে দাবি করতেন। তাকে ‘ভালুক নারী’ (বেয়ার উওম্যান) বলেও ডাকা হতো। গল্প চালু হলো — মেক্সিকোর একটি আদিবাসী গোষ্ঠীর সদস্য জুলিয়ার মাকে গোষ্ঠী থেকে বিতাড়িত করে জঙ্গলে পাঠিয়ে দেয়া হয়, এবং ওখানেই একটি গরিলা অথবা ওরাং ওটান দ্বারা গর্ভবতী হয়ে তিনি এই কুৎসিত প্রাণীটির জন্ম দেন।
অথচ জুলিয়া ছিলেন একজন স্বাভাবিক মানুষ, যিনি ঐুঢ়বৎঃৎরপযড়ংরং ষধহঁমরহমড়ংধ ও এরহমরাধষ যুঢ়বৎঢ়ষধংরধ নামের দুটি বিরল রোগে ভুগছিলেন। মৃত্যুর শত বছর পরে এই রোগ সনাক্ত করা হয়েছিল। দাসী অবস্থায় থাকার সময় তিনি লেখাপড়া শিখেছিলেন। তিনটি ভাষা জানতেন। তার গানের গলা ছিল অসাধারণ, চমৎকার নাচতেও পারতেন। অথচ শিল্পী হিসাবে তো দূরের কথা, জীবিতাবস্থায় মানুষ হিসাবেও তার কোনো স্বীকৃতি জোটেনি।
১৮৫৯ সালে জুলিয়ার স্বামী তাকে ইওরোপ নিয়ে যান, যেখানেও বিভিন্ন শহরে চলে তার প্রদর্শনী। ইউরোপে এইসব শো’ চলার সময় জুলিয়া গর্ভবতী ছিলেন ও এতো ছোট শরীরে গর্ভধারণ ও গর্ভাবস্থায় বিভিন্ন প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ ছিল কষ্টদায়ক ও ঝুঁকিপূর্ণ, তবু প্রদর্শনী থেকে তিনি রেহাই পাননি। অন্তঃসত্ত্বা জুলিয়াকে প্রদর্শনীর জন্য নিয়ে যাওয়া হয় মস্কোয়, সেখানে ১৮৬০ সালের মার্চ মাসে একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন জুলিয়া। দেখা যায় শিশুটির মুখও জুলিয়ার মতো লোমাবৃত। দুঃখজনকভাবে জন্মের ৩৫ ঘণ্টা পর শিশুটি মারা যায়। এর তিনদিন পর, সন্তান জন্মদান সংশ্লিষ্ট জটিলতায় ভুগে মাত্র ২৬ বছর বয়সে জুলিয়া পাস্ত্রানা মৃত্যুবরণ করেন। তারিখটা ছিল ১৮৬০ সালের ২৫ মার্চ।
সন্তান ও স্ত্রীর মৃত্যুর পর থিওডোর লেন্ট যা করেছেন তা অভাবনীয়। স্ত্রী ও সন্তানকে সমাহিত না করে তিনি তাদের মৃতদেহ দুটো বিক্রি করে দেন মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকের কাছে, ৫০০ পাউন্ডের বিনিময়ে। প্রফেসর সুকোলভ নামের ঐ অধ্যাপক বিভিন্ন ওষুধ ব্যবহার করে মৃতদেহ দুটো সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। যখন জুলিয়ার স্বামী দেখলেন যে মৃতদেহ দুটো নিখুঁতভাবে সংরক্ষিত হয়েছে, তখন তিনি আবার দেহদুটোর মালিকানা দাবি করে বসলেন, এবং দেহদুটো দ্বিগুণ অর্থের বিনিময়ে কিনে নিলেন। এরপর স্ত্রী ও সন্তানের মৃতদেহ কাঁচের বাক্সে ভরে বাণিজ্যিকভাবে আবারও প্রদর্শন করতে থাকেলেন ইয়োরোপের বিভিন্ন শহরে।
এভাবে প্রদর্শনীর এক পর্যায়ে জুলিয়ার স্বামী জার্মানিতে আরেকটি নারীর সন্ধান পান, যার মুখেও জুলিয়ার মতো লোম ছিল। লেন্ট ওই নারীকেও বিয়ে করে ফেলেন, এবং তাকে জেনোরা পাস্ত্রানা নাম দিয়ে প্রদর্শন করতে থাকেন। তিনি বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করতেন — জেনোরা পাস্ত্রানা হচ্ছে জুলিয়া পাস্ত্রানার বোন। এভাবে একই প্রদর্শনীতে প্রথম স্ত্রী ও সন্তানের মৃতদেহ ও দ্বিতীয় স্ত্রীকে দেখিয়ে টাকা উপার্জন করতেন লেন্ট। এভাবে বছরের পর বছর অর্থ উপার্জন করে অবশেষে থিওডোর লেন্টের স্থান হয় রাশিয়ার একটি মানসিক হাসপাতালে এবং ১৮৮৪ সালে সেখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
এরপর বহু বছরের জন্য লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যায় জুলিয়া পাস্ত্রানা ও তার শিশুপুত্রের দেহ। ১৯২১ সালে নরওয়েতে আবারও আবির্ভুত হয় দেহদুটো, বিভিন্নভাবে হাত বদল হয়ে বাণিজ্যিকভাবে প্রদর্শিত হতে থাকে পৃথিবীর কুৎসিততম নারী ও তার হতভাগ্য শিশুপুত্রের। প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে এমনি চলেছিল। ১৯৭০ সালে দেহদুটো আমেরিকায় নিয়ে যাবার প্রচেষ্টাকালে নরওয়েতে বিপুল সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয় প্রদর্শনীর আয়োজকদের। বিরোধিতার মুখে আবারও লোক চক্ষুর অন্তরালে চলে যায় দেহ দুটো, ঠাঁই হয় একটি গুদামে।
১৯৭৬ সালের আগস্ট মাসে একদল দুর্বৃত্ত ঐ গুদামে ঢুকে পড়ে। তারা ইচ্ছা বা অনিচ্ছাকৃতভাবে জুলিয়ার শিশুপুত্রের মৃতদেহটিকে ক্ষত-বিক্ষত করে। শিশুটির দেহের বাকি অংশ যায় ইঁদুরের পেটে। ১৯৭৯ সালে একদল চোর আবারও গুদামে হানা দেয় ও চুরি করে নিয়ে যায় জুলিয়ার মৃতদেহটি। সম্ভবত তারা এটিকে পুতুল ভেবেছিল। যাহোক, পরে তারা দেহটিকে একটি ডাস্টবিনে আবর্জনার মধ্যে ফেলে রেখে যায়, যাবার সময় আবার একটি হাত ভেঙ্গে সাথে নিয়ে যায়। পুলিশ মৃতদেহটি উদ্ধার করলেও সনাক্ত করতে পারেনি এটি কার দেহ। এরপর বেওয়ারিশ লাশ হিসাবে বহু বছর দেহটি পড়ে থাকে অসলো ফরেনসিক ইনস্টিটিউটে। ১৯৯০ সালে পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে জানা যায় মৃতদেহটি জুলিয়া পাস্ত্রানার। ১৯৯৭ সালে এটিকে স্থানান্তরিত করা হয় অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের এনাটমি বিভাগে, যেখানে সিল করা কফিনে ঠাঁই হয়ে জুলিয়ার।
এরপরও বহু বসন্ত কেটে গেছে, নরওয়ের গ্লোম্মা নদীতে বয়ে গেছে কত স্রোত, কত জল। পৃথিবীর আরেক প্রান্তে, আমেরিকার নিউ ইয়র্ক শহরে থিয়েটারের সঙ্গে জড়িত লরা এন্ডারসন বারবাটা নামক এক নারী জুলিয়া পাস্ত্রানার কাহিনী শুনে বেদনার্ত হলেন, ২০০৫ সালে তিনি শুরু করলেন এক অভিনব প্রচারণা। বারবাটা নরওয়ে ও মেক্সিকোর কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করলেন ও জুলিয়ার মৃতদেহ তার জন্মভূমিতে ফিরিয়ে নেয়ার প্রচেষ্টা চালাতে থাকলেন। পরবর্তীতে জুলিয়ার জন্মভূমি সিনালোয়ার মেয়রও এতে সমর্থন দেন, ও নরওয়েতে মেক্সিকোর রাষ্ট্রদূত নরওয়ের কাছে এই মৃতদেহ ফিরিয়ে দেবার আবেদন জানান। তাদের দাবি ছিল, জুলিয়া পাস্ত্রানাকে যেন মানুষ হিসাবে তার প্রাপ্য সম্মান দেয়া হয়। নরওয়ে এই সম্মান দিতে রাজি হয় ও বিভিন্ন দাপ্তরিক আনুষ্ঠানিকতা শেষে জুলিয়ার মৃতদেহ মেক্সিকো কর্তৃপক্ষের কাছে ফিরিয়ে দেয়।
অবশেষে মৃত্যুর দেড়শ’ বছরেরও বেশি সময় পরে মানুষের মর্যাদায় জন্মভূমি মেক্সিকোর সিনালোয়ায় ফিরে আসেন জুলিয়া পাস্ত্রানা ও ২০১৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি সিনালোয়ার মেয়র ও উর্ধতন কর্মকর্তাসহ শত শত লোকের উপস্থিতিতে সসম্মানে সমাহিত হন তিনি নিজ মাতৃভূমিতে।