শেষ বেলায়

ফারজানা কুমকুম

গফুর সাহেব একজন আর্মি অফিসার। তিন ছেলে আর এক মেয়ের জনক। সময়ানুবর্তিতা, নিয়মানুবর্তিতা, সততার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তিনি।
কষ্ট করে লেখাপড়া শিখেছেন। পরিবারের কেউ বাংলা শিক্ষায় শিক্ষিত ছিল না। পরিবারের সবাই মাওলানা, হুজুর। তার উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য তেমন কোনো পারিবারিক সমর্থন তাই তিনি পাননি। এজন্য কষ্টটা তাকে বেশি করতে হয়েছে। গ্রামের ছেলে হয়েও কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ, এমএ পাস করেছেন নিজের স্কলারশিপের টাকায়। নিজের যোগ্যতা ও চেষ্টায় হয়েছেন আর্মি অফিসার।
একটা সময় তাকে লজিং টিচার হিসেবে থাকতে হয়েছিল বোরহান সাহেবের বাড়িতে। বোরহান সাহেবের দুই মেয়ে, দুই ছেলে। এক ছেলে ডাক্তার, আরেকজন উকিল। ছোট মেয়েটির বয়স ছয় বছর।
আর বড় মেয়ে রানুর বয়স ১৩ বছর। বেশ লম্বা। রানুর যেমন সুন্দর গায়ের রঙ তেমনি তার রূপ। ভারী চঞ্চল, চপলা, দুষ্ট-মিষ্টি মেয়ে। সারাদিন হৈ-হুল্লোড় করে, সারা পাড়া ঘুরে বেড়ায়। কার গাছে আম আছে, কার গাছে জামরুল আছে সব তার জানা। ছোট বোনকে নিয়ে ঢিল মারে সেগুলোতে। হয়তো পায়েস করার জন্য দুধ জ্বাল করা হচ্ছে, চুপিচুপি গিয়ে দুধের সর উঠিয়ে খেয়ে নিচ্ছে। এমনি দুরন্তপনা মেয়ে রানু। খুব মেধাবী। লেখাপড়ায়ও খুব ভাল। সবসময় ক্লাসে প্রথম হয়।
গফুর সাহেবের কাছে ভালো লাগে রানুকে। তার রূপ, তার দুরন্তপনায় তিনি মুগ্ধ। রানুর বড় ভাই যিনি উকিল তার কাছে একদিন বলে ফেললেন নিজের মনের কথা। সে বিয়ে করতে চায় রানুকে। রানুর ভাই কথা দেয় গফুরকে। তুমি চাকরিতে জয়েন করার পর রানুকে বিয়ে করবে।
রানুর ভাইয়ের কথা অনুযায়ী গফুর আর্মিতে জয়েন করার পর রানুকে বিয়ে করে।
রানুর বয়স তখন মাত্র সতের কি আঠার। গফুর সাহেবের পোস্টিং তখন পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে। বিয়ে করে তারা চলে গেল পাকিস্তান। সেখানেই সংসার শুরু। একে একে তিন ছেলে হল। তাদের মেয়ের খুব শখ। একটি মেয়ে হয়ে মারা গেল। পরে আবার একটি মেয়ে হল তাদের।
রানু খুব ভাল সেলাইয়ের কাজ জানতো। সাধারণ সেলাই না। তার একেকটা সেলাইয়ের কাজ যেন একেকটা শিল্পকর্ম। সে এত চটপটে, পরিশ্রমী যে একা একা চার সন্তানের লালনপালন করেও সেলাই এর কাজ করত। শুধু জামা কাপড় সেলাই তা না। তার কাজ অসাধারণ। উলের কাজ, কুশিকাটার কাজ। বিভিন্ন কিছুর ছবি এঁকে সেগুলো সেলাই করে বাঁধিয়ে রাখত।
সে খুব মিশুক। অল্প সময়ের মধ্যেই সবার সাথে তার বন্ধুত্ব হয়ে যেত। এমনি গুণের অধিকারী রানু আশেপাশের সবার কাছে প্রিয় ভাবী হয়ে উঠল রাতারাতি। রানুর হাত ধরে গড়ে উঠল ছোট্ট একটা সংগঠন। গফুর সাহেব তার কর্মজীবন নিয়ে ব্যস্ত, রানুও তার সংসার, সংগঠন, সেলাইয়ের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। তবে রানুর কাছে খারাপ লাগে সে তার মা, বাবা, ভাই-বোনকে দেখতে পায় না বলে। এর মধ্যেই একদিন খবর আসে রানুর মা মারা গেছে। অনেক কান্নাকাটি করলেও দেশে যেতে পারেনি মাকে শেষ বিদায় জানাতে। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার কষ্ট, কর্মব্যস্ততা, এভাবেই কাটছিল তাদের দিনগুলি।
১৯৭১ সাল। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে গফুর সাহেব তার চাকরি ছেড়ে চলে এলেন দেশে। ইচ্ছে করলে তিনি চাকরিরত অবস্থায় পাকিস্তানেই থেকে যেতে পারতেন। কিন্তু দেশের মায়া তিনি ছাড়তে পারেননি। তাই চাকরিটাই ছাড়লেন। রানু আর তাদের চার সন্তান নিয়ে চলে এলেন বাংলাদেশে। দেশে ফিরে এসে কঠিন বিপদে পড়লেন। চাকরি নেই, তার উপর চারটি সন্তান। জমি-জমা থাকায় রক্ষা পেলেন কিছুটা।
গফুর সাহেব কর্মঠ আর পরিশ্রমী। তিনি বসে থাকার লোক না। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বাড়ির অদূরে একটি হাই স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। আর জমিজমা অন্য লোকদের দিয়ে চাষ করিয়ে ফসল ফলান। নিজের টাকায় আরো জমি কিনে নতুন করে বাড়ি তৈরী করেন। ছেলে-মেয়েকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলেন। তার তিন ছেলে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে পাড়ি জমায় সুদূর প্রবাসে। এক ছেলে লন্ডন, এক ছেলে অস্ট্রেলিয়া, এক ছেলে আমেরিকা। মা-বাবাকে তাদের সাথে রাখার প্রয়োজন বোধ করেনি তারা। বিধাতা জানতেন এই তিন ছেলে মা-বাবাকে শেষবেলা দেখবে না। তাই হয়ত একটি মেয়ে উপহার দিয়েছিলেন তাদের। আল্লাহর রহমতে মেয়েটিও আমেরিকা থাকে তার স্বামী-সন্তানসহ। একমাত্র মেয়ের বাসায় গফুর সাহেব আর তার স্ত্রী রানু কাটায় জীবনের শেষবলা।
জীবন সায়াহ্নে এসে রানু ভাবে, কত কিছু সে জানতো, কতকিছু সে করতে পারতো, অথচ নিজের গুণগুলোকে ছড়িয়ে দেওয়া হল না কোথাও! যখন নিজের উত্থানের সময় শুরু হয়েছিল তখন হঠাৎ করেই চলে আসতে হল দেশে। দেশে তখন মুক্তিযুদ্ধ। কি কঠিন সময় পার করতে হয়েছে। চারটি সন্তান নিয়ে প্রতিনিয়ত গুণতে হয়েছে মৃত্যুর ক্ষণ। যুদ্ধ শেষ হয়ে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সারা দেশে দুর্ভিক্ষ, চারদিকে হাহাকার। পাকিস্তানের সেই গুছানো সংসার, সংগঠন আর নিজের শখের কাজকে পেছনে ফেলে এসে কত কষ্ট করে গ্রামের বাড়িতে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য যুদ্ধ করতে হয়েছে। কত ইচ্ছে ছিল নিজের সংগঠনটা ধীরে ধীরে বড় করবে, নিজের সেলাই করা শিল্পকর্ম দিয়ে একটা শো-রুম করবে। সময় আর সুযোগের সংমিশ্রন ঘটলে হয়ত হতে পারত নামকরা সুপ্রতিষ্ঠিত একজন সফল নারী। কিন্তু করা হল না কিছুই। নিজের প্রতিভাগুলোকে দুমড়ে-মুচড়ে মিশিয়ে দেওয়া হল জীবন সংসারে! সংসারের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে এভাবেই হারিয়ে যায় কত প্রতিভা!
আর গফুর সাহেব ভাবেন, কত কষ্ট করে, কত চড়াই-উতরাই পার করে বড় হয়েছি। একজন আর্মি অফিসার ছিলাম। দেশের মায়ায় নিজের সরকারি চাকরি ছেড়ে চলে এসেছিলাম দেশে। ইচ্ছে ছিল তিন ছেলে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা হবে, দেশের সেবা করবে। কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস! সরকারি কর্মকর্তা তো দূরের কথা, তারা কেউ দেশেই রইল না!
আর আজ আমিও প্রবাসে থেকে মৃত্যুর দিন গুণছি। অনেকের কাছে প্রবাস জীবন অনেক দামি, অনেক সুখের। কিন্তু গফুর সাহেবের মত দেশপ্রেমী মানুষের কাছে দেশ থেকে দূরে থাকাটা কষ্টের।
আর তিন তিনজন সুপ্রতিষ্ঠিত ছেলে থেকেও শেষ বয়সে মেয়ের কাছে থাকতে হচ্ছে, এটাও খুব পীড়া দেয় তাকে। যদিও মেয়ের জামাই খুবই ভাল। নিজের ছেলেদের চেয়েও অনেক বেশি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা দিয়ে যাচ্ছে। তবুও আত্মসম্মানের জায়গাটাতে নিজেকে খুব অসহায় লাগে। এমন একটা স্পর্শকাতর ব্যাপার যে নিজের স্ত্রী, সন্তান, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব কারো সাথে এটা শেয়ারও করতে পারেন না। নিজেই বহন করে চলেন নিজের ব্যাথা-বেদনা।
আর কেবলই ভাবেন, চাইনি দেশ ছেড়ে দূরে থাকতে। অথচ ভাগ্যে লিখা ছিল প্রবাস! জীবন কি এমনই হয় মানুষের? যা সে চায় না তা-ই তাকে বহন করত হয়!

১৯ আগস্ট, ২০২১।