মতলব উত্তরে ঝুলন্ত সেতু নির্মাণ প্রকল্প বাতিল হচ্ছে

মনিরুল ইসলাম মনির
রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে মনে করে মেঘনা নদীতে ঝুলন্ত সেতু প্রকল্প বাতিল হচ্ছে। অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক না হওয়া সত্বেও নিজের প্রভাব খাটিয়ে মেঘনা নদীর ওপর ঝুলন্ত সেতু নির্মাণ প্রকল্প পাস করিয়ে নেন সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম। আওয়ামী সরকারের সুবিধা ভোগ করা সাবেক এই আমলা চাঁদপুর-২ (মতলব উত্তর-দক্ষিণ) আসন থেকে নির্বাচন করারও ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। সেজন্য নিজ এলাকার কিছু প্রকল্প পাস করান তিনি। তার মধ্যে অন্যতম ‘মতলব উত্তর-গজারিয়া সড়কে মেঘনা-ধনাগোদা নদীর ওপর সেতু নির্মাণ প্রকল্প’। রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রকল্প দুটি নেওয়া হয়েছে বলে তা বাতিল করা হবে বলে পরিকল্পনা কমিশনের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
পরিকল্পনা কমিশন জানায়, দীর্ঘদিন ধরে দেশের আর্থিক খাত ধুঁকছে। রয়েছে ডলার সংকট। এর মধ্যে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে দেখা দিয়েছে নতুন সংকটের শঙ্কা। এতে আওয়ামী লীগ সরকারের নেওয়া চলতি অর্থবছর এবং পরের বছর মিলে সম্ভাব্য ৩ হাজার ৩২৫টি উন্নয়ন প্রকল্পের ভাগ্য অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এগুলোর মধ্যে চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরে ১ হাজার ২২১টি প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ ২ লাখ ৫৫ হাজার ৪১ কোটি টাকা। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দিতে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ও সচিবদের সঙ্গে বৈঠক করেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
পরিকল্পনা কমিশন জানায়, ছোটবড় সব প্রকল্পের বিষয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করছে কমিশন। যেসব রাজনৈতিক প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে সেগুলোর বিষয়ে কোনো কথা নয়, তবে যেগুলো প্রাথমিক ধাপে আছে সেই প্রকল্পে বরাদ্দ নয় বলে জানিয়েছে কমিশন। সেই হিসেবে মেঘনা নদীর ওপর ঝুলন্ত সেতু নির্মাণ প্রকল্পটি প্রাথমিক পর্যায়ে। এখনো মাঠ পর্যায়ে অবকাঠামোগত কাজ শুরু হয়নি। সেজন্য প্রকল্প দুটিতে টাকা বরাদ্দ দেওয়া হবে না বলে কমিশন জানিয়েছে।
রাজনৈতিক প্রকল্প বাদ দেওয়া প্রসঙ্গে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ গণমাধ্যমকে বলেন, যেসব প্রকল্প রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে এবং বাস্তবায়নও প্রায় শেষ পর্যায়ে সেগুলোর বিষয় তো কিছু করার নেই। আমি পরিকল্পনা কমিশনের সেক্টরগুলোতে নির্দেশনা দিয়েছি অপ্রয়োজনীয় এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া নতুন কোনো প্রকল্প যাতে না নেওয়া হয়।
প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে সেতু বিভাগ। প্রকল্পটি বাতিল হচ্ছে কি? এমন প্রশ্নের জবাবে সেতু বিভাগের সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম বলেন, আপনারা হয়তো জানেন আমি সেতু বিভাগে নতুন যোগদান করেছি। তাই কোন প্রকল্পটি বাতিল হচ্ছে, কোনটা হচ্ছে না, সেই বিষয়টি এখনো জানি না।
দেশে প্রথমবারের মতো ৪ লেন বিশিষ্ট ঝুলন্ত সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয় মতলব উত্তরে। চীনের সুটং ইয়াংজি নদী সেতু, ভারতের রাজিব গান্ধী সমুদ্র সেতু, ফ্রান্সের মিলাউ ভায়াডাক্ট কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকো-ওকল্যান্ড বে ব্রিজের মতো বাংলাদেশেও কেবল স্টেড বা ঝুলন্ত (তারের) সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ সরকার।
চাঁদপুর ও মুন্সীগঞ্জ জেলায় সংযোগ স্থাপনকারী ঝুলন্ত এ সেতুটি নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ৪ হাজার ১৭৪ কোটি ৬৭ লাখ ৯৬ হাজার টাকা। মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া ও মতলবের মেঘনা-ধনাগোদা নদীর ওপর ৪ লেনের ঝুলন্ত এ সেতুটি নির্মাণ হওয়ার কথা ছিল।
সেতুর মোট দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৮৫০ মিটার। এর সঙ্গে সাড়ে ৭ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হতো। প্রকল্পটির কাজ ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে শুরু হয়ে ২০২৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেষ হওয়ার কথা ছিল। দেশীয় এবং বিদেশি অর্থে সড়ক ও জনপথ বিভাগ এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করার কথা। প্রকল্পের মোট ব্যয়ের মধ্যে কোরীয় ঋণ ৩ হাজার ৫১৩ কোটি ৯৬ লাখ টাকা এবং বাকি ৬৬০ কোটি ৭২ লাখ টাকা সরকারি কোষাগার থেকে মেটানো হবে। প্রকল্পে এখন পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৪৬ লাখ ৫২ হাজার টাকা, যা মোট ব্যয়ের মাত্র ০ দশমিক ০১ শতাংশ।
সেতুটি নির্মাণ হলে ৩ জেলার মানুষ সহজে এবং স্বল্প সময়ে রাজধানী ঢাকাসহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় যাওয়া-আসা করতে পারার কথা বলে প্রকল্পটি অনুমোদন করিয়ে নেওয়া হয়। অথচ মুন্সীগঞ্জ, নোয়াখালী ও চাঁদপুর থেকে ঢাকায় যাতায়াতের সড়ক ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে। প্রকল্পটি নেওয়ার সময় পরিকল্পনা কমিশন ইতিবাচক অর্থনৈতিক মতামত দেয়নি। তারপরও অনুমোদন করে নেওয়া হয় প্রকল্পটি।
সেতুটির রুটে ছোট ছোট যানবাহন চলাচল করে। ফলে প্রকল্পে যে খরচ হবে তা টোল আদায় করে উঠবে না। ফলে এটা একটি অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প ও বাড়তি খরচ বলে মতামত দিয়েছে কমিশন। প্রকল্পটি প্রাথমিক ধাপে আছে বলে বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন।

১৭ অক্টোবর, ২০২৪।