ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৮ মাসে খরচ হয়েছে ৮০ হাজার ১৪৩ কোটি টাকা * এখনও ১৪ মন্ত্রণালয়ের এডিপি বাস্তবায়ন ২০ শতাংশের নিচে * প্রকল্পের মানসম্মত বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জের মুখে -আইএমইডি সচিব * সবকিছু নির্ভর করছে করোনার স্থায়িত্বের ওপর -পরিকল্পনা সচিব
চলতি অর্থবছরের বাকি চার মাসে (মার্চ, এপ্রিল, মে, জুন) সংশোধিত এডিপির প্রায় ১ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে। কারণ গত আট মাসে সেভাবে ব্যয় হয়নি। এই ৮ মাসে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের অনুকূলে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো ব্যয় করেছে মাত্র ৮০ হাজার ১৪৩ কোটি টাকা।
কাজেই আগামী চার মাসের মধ্যেই বিপুল অংকের এ টাকা ব্যয় করতে হবে। এবার মোট ২ লাখ ১ হাজার ১৯৮ কোটি টাকার সংশোধিত এডিপি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
চলতি অর্থবছরে এ পর্যন্ত ১৪ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের এডিপি বাস্তবায়নের হার ২০ শতাংশের নিচে। এমনিতেই প্রকল্প বাস্তবায়ন কম। এর মধ্যে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে দেখা দিয়েছে করোনাভাইরাস। এই পরিস্থিতিতে ঝুঁকির মুখে পড়েছে সংশোধিত এডিপির বাস্তবায়ন। কেননা বিভিন্ন প্রকল্পে আন্তর্জাতিক দরপত্র অনুযায়ী কাজ চলছে। এছাড়া বিদেশি শ্রমিক, নির্মাণ যন্ত্রাংশ এবং উপকরণ সরবরাহ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব আবুল মনসুর মো. ফয়েজ উল্লাহ সোমবার যুগান্তরকে বলেন, করোনার কারণে অবশ্যই আরএডিপির কাঙ্ক্ষিত বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। তবে আমরা চেষ্টা করব পরিস্থিতির উন্নতি হলে প্রয়োজনে শিফটিং’র মাধ্যমে হলেও কাজ করে প্রকল্পের গতি বাড়ানো হবে।
অনেক প্রকল্পে বিদেশি ঠিকাদার, পণ্য ও ইকুপমেন্ট যুক্ত রয়েছে। কিন্তু সেসব ডেলিভারি হতে দেরি হচ্ছে। এছাড়া অর্থ ব্যয় করা তো বড় কথা নয়, প্রকল্পের মানসম্মত বাস্তবায়নের ঝুঁকি রয়েছে। তবে আমাদের মনোবল শক্ত আছে, দেখা যাক কি হয়। আইএমইডি প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের হার দাঁড়িয়েছে ৩৭ দশমিক ২৬ শতাংশ। যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৩৯ দশমিক ১৩ শতাংশ।
এটি গত অর্থবছরের তুলনায় ১ দশমিক ৮৭ শতাংশ কম। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ৮ মাসে এডিপি বাস্তবায়নের হার ছিল ৩৮ দশমিক ০১ শতাংশ। সে তুলনায় শতাংশের দিক থেকেও চলতি অর্থবছর বাস্তবায়ন হার কমেছে। গত আট মাসে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় করছে ৮০ হাজার ১৪৩ কোটি টাকা।
গত অর্থবছর ব্যয় হয়েছিল ৭০ হাজার ৭৭১ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। তার আগের অর্থবছর ব্যয় হয়েছিল ৬২ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা। জানতে চাইলে পরিকল্পনা সচিব মো. নূরুল আমিন যুগান্তরকে বলেন, কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় সংশোধিত এডিপি বাস্তবায়ন নাও হতে পারে। তবে সবকিছুই নির্ভর করছে করোনাভাইরাসের এ অবস্থা কতদিন স্থায়ী হয় তার ওপর।
করোনার প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হলে প্রকল্পের বাস্তবায়ন কমে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ এটি বাংলাদেশের একার সমস্যা নয়, এটা সারাবিশ্বের সংকট। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকারিভাবে নাগরিকদের বিভিন্ন নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরাও সেসব নির্দেশনাই ফলো করবেন। এখানে শুধু পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের আলাদা কোনো নির্দেশনা দেবে না।
আইএমইডি বলেছে, এখন পর্যন্ত এডিপি বাস্তবায়ন ২০ শতাংশের নিচে থাকা মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো হচ্ছে- রেলপথ মন্ত্রণালয়, তারা ১৬ দশমিক ২২ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়ন করেছে। এছাড়া সুরক্ষা ও সেবা বিভাগ ১১ দশমিক ৩৪ শতাংশ, পরিবেশ-বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় ১৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ এবং শিল্প মন্ত্রণালয় ৬ দশমিক ২৮ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়ন করেছে।
পিছিয়ে থাকা অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো হল- অভ্যন্তরীণ বিভাগ দুই দশমিক ১৫ শতাংশ, আইন ও বিচার বিভাগ ১৭ দশমিক ৯৯ শতাংশ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ১২ দশমিক ১৪ শতাংশ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ১১ দশমিক ৬৪ শতাংশ, পরিকল্পনা বিভাগ (থোকসহ) ১৯ দশমিক ১৬ শতাংশ, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ ১৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ, বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন ১৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ, দুর্নীতি দমন কমিশন ১২ দশমিক ১৫ শতাংশ এবং লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের এডিপি বাস্তবায়ন হার দাঁড়িয়েছে ১৪ দশমিক ০১ শতাংশ।
সংশোধিত এডিপি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, করোনার প্রভাবে ইতোমধ্যেই বেশকিছু প্রকল্পের কাঙ্ক্ষিত বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে সংশোধিত এডিপিতে অর্থ ফেরত দেয়া হয়েছে। এগুলোর অধিকাংশ প্রকল্পেই অর্থায়নসহ কোনো না কোনোভাবে বৈদেশিক সংশ্লিষ্টরা রয়েছে। চলতি অর্থবছরের মূল এডিপিতে পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ ছিল ৫ হাজার ৩৭০ কোটি ৬৯ লাখ টাকা।
সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৪ হাজার ১৫ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে বরাদ্দ কমছে ১ হাজার ৩৫৫ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ প্রকল্পে বৈদেশিক সহায়তা অংশে বরাদ্দ ছিল ৯৪৯ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। আর সরকারি তহবিলের অংশে বরাদ্দ ছিল ৪০০ কোটি টাকা।
এখন বৈদেশিক সহায়তা অংশে ৮৭৮ কোটি ৫৬ লাখ টাকা রাখা হয়েছে। ফলে কমছে প্রায় ৭২ কোটি টাকা। এছাড়া মেট্রোরেল প্রকল্পটিতে বরাদ্দ ছিল ৭ হাজার ২১২ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। সেখান থেকে ২ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা কমিয়ে সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪ হাজার ৩২৬ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ১৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা।
এখন নতুন বরাদ্দ ধরা হয়েছে ১৪ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা। ফলে কমেছে ১৩৪ কোটি টাকা। এছাড়া পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ৩ হাজার ৯৯৫ কোটি ২০ লাখ টাকা। সংশোধিত বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৩ হাজার ২৯৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা। কমেছে ৬৯৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
সাপোর্ট টু ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পিপিপি প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ৩৮ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। সংশোধিত বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৪০১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এ প্রকল্পে বরাদ্দ কাটছাঁট হয়েছে ৬৩৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা। ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ৭০৫ কোটি টাকা।
সংশোধিত বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৬৫৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। ফলে কমছে প্রায় ৫১ কোটি টাকা। ঢাকা শহরে সাবওয়ে (আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রো) নির্মাণে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পরিচালনা প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ২২৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা। সংশোধিত বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৬১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। এতে বরাদ্দ কমেছে প্রায় ২১ কোটি টাকা।