আ.লীগের উন্নয়ন ও বিএনপির সমর্থনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা

একাদশ জাতীয় নির্বাচন : চাঁদপুর-৩ (চাঁদপুর সদর-হাইমচর)

ইল্শেপাড় রিপোর্ট
আসাম বেঙ্গল গেটওয়ে খ্যাত রূপালী ইলিশের শহর চাঁদপুর ও পান সুপারি নারিকেলের প্রাচুর্য হাইমচর নিয়ে চাঁদপুর-৩ আসন। জাতীয়তাবাদী শক্তির ঘাঁটি তথা বিএনপি’র ভোট ব্যাংক খ্যাত চাঁদপুর সদর আসন ’৯১ সাল থেকে ১/১১ পর্যন্ত ছিল বিএনপির দখলে। ১/১১ পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনে বেকায়দায় পরে বিএনপি। তাদের ভোট ব্যাংকে ভাগ বসায় আওয়ামী লীগ।
১/১১ সময়ের রাজনৈতিক পরিবর্তিত নবম সংসদ নির্র্বাচনকে কাজে লাগিয়ে আওয়ামী লীগ চাঁদপুর-৩ দখল নেয়। ফলে দীর্ঘ ৩৫ বছর পর আসনটি নিজেদের করে নেয় আওয়ামী লীগ। যদিও বিএনপি তাদের ব্যর্থতার জন্য দায়ী করে আসছে সময়মতো চাঁদপুর ও হাইমচরকে মেঘনার ভাঙন থেকে রক্ষা করতে না পারাকে। আর জাটকা (ইলিশের পোনা) রক্ষার নামে জেলেদের রুদ্ররোষের। ফলে জনমত দ্রুত চলে যায় আওয়ামী লীগের দিকে। তাই স্বল্প পরিচিতি নিয়ে কেন্দ্রিয় আওয়ামী লীগের বর্তমান যুগ্ম-সম্পাদক ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি নবম সংসদ নির্বাচনে আসনটি ঘরে তুলে নেন আওয়ামী লীগের জন্য।
তবে এখন সময় বদলেছে, বাড়ছে নতুন ভোটার। ভোটের সমীকরণ নিয়ে ভাবছে আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ নতুন প্রজন্মের ভোটাররা। আসনটিতে একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-বিএনপি নিজেদের করে নিতে নতুন ছক আঁকছে। ফলে উভয় দলে নতুন মুখ আসার চেষ্টা করছে বলে তাদের সমর্থকরা জানান।
যদিও বর্তমান সংসদ ডা. দীপু মনি আত্মবিশ্বাস নিয়েই ভোটের মাঠে পদাচারণা করছেন। তবে কেন্দ্রিয় আওয়ামী লীগ নবীন-প্রবীণে প্রার্থী দেয়ার ঘোষণায় হাল ছাড়েনি তরুণ নেতা সুজিত রায় নন্দীও।
অপরদিকে বিএনপিতে জিএম ফজলুল হক না শেখ ফরিদ আহমেদ মানিক তা’ নিয়ে রয়েছে ধূ¤্রজাল। সাম্প্রতিক জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট তৈরি হওয়ায় বিএনপি প্রার্থীরা আছে বেকায়দায়। এ আসনে শেখ মানিকের সমর্থকরা আশাবাদী দল তাকে’ই মনোনয়ন দিবে। তবে ঐক্যেফ্রন্টের কারণে প্রার্থীতা হাতছাড়া হলে বিস্ময়ের কিছুই থাকবে না বলে বিএনপির নেতাকর্মীরা ভাবছে।
বর্তমানে চাঁদপুর-৩ (চাঁদপুর সদর- হাইমচর) সংসদীয় আসনে নির্বাচন কমিশনের হালনাগাদ ভোটার তালিকানুযায়ী মোট ভোটার ৪ লাখ ১৭ হাজার ৪শ’ ৪৩ জন। এদের মধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ১৫ হাজার ৬শ’ ৯০ জন ও নারী ভোটার ২ লাখ ১ হাজার ৭শ’ ৫৩ জন। এই ভোটারদের মাঝে আছে প্রায় অর্ধ লাখেরও বেশি নতুন ভোটার, যারা এবারের একাদশ সংসদ নির্বাচনে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে। তারাই হবে জয়-পরাজয়ের মূল ফ্যাক্টর।
তবে ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী ডা. দীপু মনি এমপি টানা ২ মেয়াদে নির্বাচিত হওয়ায় অনেকটাই আছেন সুবিধাজনক অবস্থায়। প্রথমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেন। ফলে তিনি বেশ কিছু নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করেন। স্বল্প সময়ে তিনি চাঁদপুর ও হাইমচরকে নদী ভাঙনরোধে নদী রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করেন। সাথে চাঁদপুরে ১শ’ ৫০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ও চাঁদপুর-লাকসাম রেলপথের কাজ দৃশ্যমান করেন।
তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ফের দলীয় মনোনয়নে ফের বিনা ভোটে নির্বাচিত হন ডা. দীপু মনি। বিগত প্রায় দশ বছরে ডা. দীপু মনি এমপি তার নির্বাচনী এলাকায় প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকার উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন। এছাড়া বাস্তবায়নাধীন উল্লেখযোগ্য প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে চাঁদপুর আধুনিক নৌ বন্দর ও হাইমচরে বিশেষ অর্থনৈতিক জোন এবং চাঁদপুর মেডিকেল কলেজ।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে ডা. দীপু মনি এমপি বলেন, চাঁদপুর সদর এবং হাইমচরের জনগণ সুযোগ দিয়েছে বলেই গত দশ বছরে আমি আমি আমার নির্বাচনী এলাকায় সেবা করে যাচ্ছি, ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে এবং হচ্ছে। আবারো আমি আমার এলাকার জনগণের দোয়া ও সমর্থন চাই।
চাঁদপুর-৩ আসন থেকে গত নবম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তিনবারের সাবেক সংসদ সদস্য জিএম ফজলুল হক। ডা. দীপু মনির সাথে নবম সংসদ নির্বাচনে তার পরাজয় ঘটে। তার পরাজয়ের ক্ষেত্রে তখন নিজ দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধকে দায়ী করেন দলের অনেক নেতা কর্মী। এবারো তিনি দল থেকে মনোনয়ন চাইবেন বলে জানা গেছে।
তবে ব্যবসায়ীক আর বয়সের কারণে তিনি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপির পরবর্তী প্রার্থী হচ্ছেন বর্তমান জেলা আহ্বায়ক শেখ ফরিদ আহমেদ মানিক। তবে একাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট তৈরি হওয়ায় চাঁদপুর-৩ আসনে প্রার্থী হিসেবে নতুন মুখ আসার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানা গেছে।
অপরদিকে চাঁদপুর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক শেখ ফরিদ আহমেদ মানিক নির্বাচনে নিজের অবস্থান নিশ্চিত করতে জেলা বিএনপি এবং অঙ্গ সংগঠনের মূল নেতৃত্বে তার অনুগত নেতাদের অন্তর্ভুক্ত করে বর্তমানে দলীয়ভাবে শক্ত অবস্থান তৈরি করে নিয়েছেন। এছাড়া তিনি তারেক রহমানের একান্ত বিশ্বস্ত হিসেবে রাজনীতির মাঠে চাউর আছে। বিএনপির কেন্দ্রিয় নেতাদের সাথেও আছে তার ব্যাপক প্রভাব।
চাঁদপুর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী শেখ ফরিদ আহমেদ মানিক জানান, শুধু চাঁদপুর-৩ আসন কেন, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে চাঁদপুরের পাঁচটি আসনেই দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে চাঁদপুরবাসী উপহার দিতে প্রস্তুত রয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। ছাত্রলীগ, যুবলীগ বাহিনীর সাথে পুলিশ বাহিনীর একাকার হয়ে নির্বাচনকে আওয়ামী লীগের পক্ষে প্রভাবিত করবে। চাঁদপুর-৩ আসনে ছাত্রদল, যুবদলসহ বিএনপি ঐক্যবদ্ধভাবে আগামি নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত রয়েছে।
এদিকে একাদশ সংসদ নির্বাচন যতই কাছে আসছে ততই চাঁদপুর-৩ আসনটি আলোচনায় চলে আসছে। বিএনপি-আওয়ামী লীগ আসনটি নিজদের করে নিতে ভোটের মাঠে দৌঁড়-ঝাপ অব্যাহত রাখলেও নতুন মুখ ভিড় করছে উভয় দলেই। আওয়ামী লীগে ডা. দীপু মনির বিপরীতে শক্ত অবস্থানে আছেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা, কেন্দ্রিয় আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী। এছাড়া জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও চাঁদপুর পৌর মেয়র নাছির উদ্দিন আহম্মেদও ভোটের মাঠে প্রার্থী হিসেবে নিজকে জানান দিয়েছেন। আরেক প্রার্থী কেন্দ্রিয় মৎস্যজীবী লীগের নেতা রেদওয়ান খান বোরহানও আছেন মনোনয়ন প্রত্যাশীর তালিকায়। ফলে শেষ পর্যন্ত কে হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী এই মুহূর্তে জেলা আওয়ামী লীগ নিশ্চিত করতে পারছে না।
অপরদিকে বিএনপিতে নতুন মুখ হিসেবে রয়েছেন সাবেক সংরক্ষিত সংসদ রাশেদা বেগম হীরা, চাঁদপুর পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা যুবদলের সাবেক সভাপতি শফিকুর রহমান ভূঁইয়া ও বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য এস এম কামাল উদ্দিন। ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে জানা গেছে গণফোরামের জেলা সভাপতি অ্যাড. সেলিম আকবর, নাগরিক ঐক্যর কেন্দ্রিয় নেতা অ্যাড. ফজলুল হক সরকার, এলডিপির সাবেক সংসদ সদস্য প্রফেসর মোহাম্মদ আবদুল্লা প্রমুখ। এছাড়া খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় যুগ্ম-মহাসচিব সাংবাদিক রোকনুজ্জামান রোকনের নামও প্রার্থী হিসেবে শোনা যাচ্ছে। চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলনও প্রার্থী দিবে বলে জানা গেছে।